সে এক সময় ছিল। বছরে একটির বেশি সিরিজ হত খুব কম। একটি সিরিজে তিনটি বা চারটির বেশি টেস্ট হলে সেটা ব্যতিক্রম হিসেবেই গণ্য হত তখন। এবং তখন অত্যন্ত বেশি রকমের স্পিন নির্ভর ছিল চারজন 'কোয়ালিটি স্পিনার' সমৃদ্ধ ভারতীয় ক্রিকেট।
চার স্পিনারের মধ্যে কাউকে না খেলানো এবং তাদের মধ্যে কে মাঠের বাইরে বসবেন, সেটা ঠিক করে ফেলা তখন খুব কঠিন কাজ ছিল ভারতীয় নির্বাচকদের জন্য এবং একটি টেস্ট ছাড়া এ দায়িত্ব তারা পালন করেছেন দক্ষতার সঙ্গে। সত্তরের দশকে এমনও দেখা যেত, একদিকে বোলিং ওপেন করতেও ডাক পেতেন কোন এক স্পিনার।
আর প্রথম দশ ওভার খেলার মধ্যেই অবশ্যম্ভাবীভাবে দু'দিকের বোলিং দায়িত্বে এসে যেতেন দুই স্পিনার। এ ভাবেই নিয়মিত হারতে থাকা দলটাকে আস্তে আস্তে জয়ের সরণীতে উঠে পড়তে অভ্যস্ত করে তুলেছিলেন ওই 'স্পিন চতুষ্টয়'।
সেই রকম এক সময় প্রায় ১৭ বছরের কেরিয়ারে মাত্র ৪৯ টি টেস্ট খেলেছিলেন তিনি, ওই চার স্পিনারের একজন। অবশ্য ওই ১৭ বছরের মধ্যে ৫ বছর, ১৯৬২-১৯৬৩ থেকে ১৯৬৬-৬৭ তাঁকে দলের বাইরে থাকতে হয়েছিল। ১৯৬২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি প্রথম টেস্ট খেলেন মাদ্রাজে, ১৯৬১-৬২র ভারত বনাম ইংল্যান্ড সিরিজের পঞ্চম ও শেষ ম্যাচে।
পেয়েছিলেন একটি মাত্র উইকেট, ব্যাটে করেছিলেন অপরাজিত ৯ ও ১৭ রান। তবু পরের পাঁচ টেস্টের অ্যাওয়ে সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজগামী বিমানে জায়গা হয়েছিল তার। প্রথম টেস্টে বাদ। দ্বিতীয় টেস্টে ছয় ও অপরাজিত এক রান এবং ১২২ রানে তিন উইকেট, যার মধ্যে ছিল রোহান কাহ্নাইয়ের উইকেটও।
তারপরে বাকি তিনটে টেস্টে আবার বাদ যান। ০-৫ ম্যাচে হেরে আসা ওই সিরিজের পরের পাঁচ বছরের জন্য তার টিমে ঢোকার দরজা বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। ওই অবস্থায় অন্য কেউ হলে হয়ত দুই টেস্টে চার উইকেটেই তাঁর কেরিয়ার শেষ হয়ে যেত। কিন্তু তিনি ছিলেন অন্য ধাতের।
ওই পাঁচ বছরে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী তুলে নেন তিনি, তাঁর অধ্যয়ন দক্ষতায়। দলে ফেরেন ১৯৬৭ সালের ইংল্যান্ড সফরে। এবং ১২ উইকেট নেন ৩ ম্যাচে। লাহোরে গদ্দাফি স্টেডিয়ামে ২৭ অক্টোবর ১৯৭৮ তারিখে শেষ টেস্ট খেলতে নামা অবধি আর পিছনে তাকাতে হয়নি তাঁকে এরপর।
৪৯ টেস্টে ১৮৯ উইকেট, যার মধ্যে ইনিংসে ৫ উইকেট ছিল ১০ বার আর ম্যাচে ১০ উইকেট ছিল দু'বার। সেরা বোলিং ছিল ৮/৭৬ আর ১১/১৪০, যথাক্রমে ইনিংস আর ম্যাচে। ৩০.৩৮ ছিল উইকেটপ্রতি রানের গড় এবং ২.৪০ ছিল তার ওভারপ্রতি ইকনমি রেট।
২০ টেস্টে ১০০ উইকেট নিয়েছিলেন তিনি, যা ছিল তখন ভারতীয় বোলারদের মধ্যে দ্রুততম এবং পরে যা ভেঙে দেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন। তার সময়ে তিনি ছিলেন ভারতের তো বটেই, ক্রিকেট দুনিয়ারও অন্যতম এক সেরা অফস্পিনার। দ্রুতগতিতে করা হাই অ্যাকশনের সঙ্গে বলের লাইন আর লেংথের উপর নিখুঁত নিয়ন্ত্রণ ছিল।
উঁচু ফ্লাইট বলে বাউন্স এনে দিত স্বতস্ফূর্তভাবেই। মাঝে মাঝে বড়মাপের বল ঘোরালেও স্পিনের চেয়েও বেশি ঘাতক ছিল তার ফ্লাইটের হেরফের। হাওয়ার ব্যাটসম্যানদের ভুল করাতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। বলের ফ্লাইটের হেরফেরে বিভ্রান্ত ব্যাটসম্যানরা মন্ত্রমুগ্ধের মত উইকেট দিয়ে যেতেন।
খুব বড় মাপের না হলেও তাঁর ব্যাট মাঝে মাঝে বিপক্ষের বোলিংয়ের সামনে দেওয়াল তুলে দিয়ে ভারতীয় ব্যাটিংয়ের 'লেজ'কে স্বাভাবিক দৈর্ঘ্য থেকে মুক্তি দিত। ৪৯ টেস্টে ১১.৪৮ গড়ে তার রান ছিল ৭৩৫ (সর্বোচ্চ ৩৭)। তাঁর অধিনায়কত্বে দু'বার রঞ্জি ট্রফি জিতেছিল কর্ণাটক।
তাঁকে ভারতীয় ক্রিকেট চিনত এরাপল্লী অনন্তরাও শ্রীনিবাস প্রসন্ন বা সংক্ষেপে এরাপল্লী প্রসন্ন নামে। তাঁর আত্মজীবনীর নাম 'ওয়ান মোর ওভার'। তাঁর বলের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতেন ইয়ান চ্যাপেল। তাঁকে ডাকতেন 'ইঞ্জিনিয়ার অব স্পিনিং' নামে। শেন ওয়ার্নকে এরাপল্লী প্রসন্নর সঙ্গে পরিচয় করাতে গিয়ে চ্যাপেল বলেছিলেন, ‘শোনো, তুমি বিশ্বের অন্যতম সেরা স্পিনারের সঙ্গে কথা বলছ।’
১৯৪০ সালে আজকের দিনে জন্মেছিলেন এরাপল্লী প্রসন্ন। ভারতীয় স্পিন চতুর্ভুজের অন্যতম প্রসন্ন ২৩৫ টি প্রথম শ্রেণির খেলায় ৯৫৭ উইকেট নেন। কর্ণাটক কে প্রথম বার তিনি নেতৃত্ব দেন ১৯৭৩-৭৪ সালে এবং সেইবারই টানা ১৫ বছর রঞ্জি জেতার পর বোম্বে ফাইনালে উঠতে ব্যর্থ হয়। ১৯৭৮ সালের পাকিস্তান সফরের পর অবসর নেন 'প্রসন্ন।
শুধুমাত্র স্পিন বোলিং উপযোগী পিচেই তিনি যে সফলতা পেয়েছেন তা নয়। বিদেশের মাটিতেও এর ধারা অব্যাহত রাখেন। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে সেরা বোলিং ৫০ রানে ৮ উইকেট । রান করেছেন ২৪৭৬,সর্বোচ্চ ৮১ । লিস্ট এ ক্রিকেটে ৯ম্যাচে উইকেট পেয়েছেন ১৭টি,সেরা বোলিং ২৯রানে ৩উইকেট । রান করেছেন ৩৩,সর্বোচ্চ ২২। ১৯৭০ সালে পদ্মশ্রী পদকে ভূষিত হন। এরপর ২০০৬ সালে ক্যাস্ট্রল আজীবন সম্মাননা পুরস্কার লাভ করেন। ২০১২ সালে ৫০-এর অধিক টেস্ট খেলায় অংশগ্রহণ করায় বিসিসিআইয়ের কাছ থেকে পুরস্কার পান তিনি।