১৯৩২ সাল। ধলঘাটের সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে আত্মগোপন করে রয়েছেন মাস্টারদা সূর্য সেন। পুলিশ ক্যাম্পের কাছাকাছি মাস্টারদা আত্মগোপন করার জায়গা। এ ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। মে মাসের অসহ্য গরমে ছটফট করতেন ওখানে। একদিন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এলেন দেখা করতে।
মাস্টারদার মনে হয়েছিল অহংকারহীন, দেশপ্রেমের প্রতি কর্তব্যনিষ্ঠ, ভক্তিমতী এক মহিলা প্রীতিলতা যেন প্রদীপের মত। সেই সময়ে বিপ্লবী দলে মেয়েদের যোগদানের ক্ষেত্রে ছিল নানা বাধানিষেধ। ক্ষুন্ন হয়েছিলেন প্রীতিলতা। মাস্টারদাকে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন ''মেয়েদের আপনার দলে নিতে চাইতেন না কেন দাদা? তাঁরা কি দেশসেবার যোগ্য নন?''
খানিকক্ষণ মাস্টারদা চুপ থেকেছিলেন এমন প্রশ্নের সামনে। মাস্টারদার হাতে তখন আয়ারল্যান্ডের বিপ্লবী ড্যানিয়েল ব্রিনের বিখ্যাত বই, ''মাই ফাইট ফর আইরিশ ফ্রিডম''। তিনি তখন প্রীতিলতার হাতে তুলে দেন সেই বই। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন সেই বই পড়ে। মাস্টারদার নির্দেশেই তিনি গৃহত্যাগ করে বিপ্লবের ক্ষেত্রে তাঁর বাকি এবং পরবর্তী কার্যকলাপ সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
দেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন আর বই, নিজের এই দুই ভালোবাসার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতেন মাস্টারদা সূর্য সেন। প্রতিদিন সময় করে কোন একটা বই পড়তেন মাস্টারদা। তিনি মনে করতেন নিজের ভেতরে একটা আলো জ্বালিয়ে রাখার জন্য বই হতে পারে শান্তির আশ্রয়। তাই ঝড়ঝাপটা, লড়াই সবকিছুর মধ্যে থেকেও আশ্চর্য রকম ভাবে শান্ত থাকতে পারতেন মাস্টারদা।
নির্মল সেন বলেছিলেন ''মাস্টারদা কারও কাছে কিছু চান না, ওকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। একেক সময় নানা চিন্তায় আমার ঘুম হয় না, আর মাস্টারদা একটা বই শেষ করে শোয়া মাত্রই ঘুমিয়ে পড়েন। ঠিক ছোট বাচ্চার মত, আমার ভারী চমৎকার লাগে।'' এমনই আশ্চর্য এক মানুষ ছিলেন মাস্টারদা সূর্য সেন।
১৮৯৪ সালের ২২শে মার্চ জন্ম মাস্টারদা সূর্য সেনের। তাঁর গ্রামের নাম নয়াপাড়া। কর্ণফুলী নদীর পাশে। ছোট থেকেই পড়াশোনার প্রতি ছিল বিশেষ আগ্রহ। মেধাবী ছাত্র হিসেবে মাস্টারদা সূর্য সেন নিজেও ছিলেন শিক্ষকদের বড় প্রিয়। মাস্টারদার ভালো লেগেছিল সেই স্কুলের আর এক মাস্টারমশাই হেমেন্দ্রবাবুকে।
প্রিয় মাস্টারমশাই হেমেন্দ্রবাবুর উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি মুগ্ধ করেছিল মাস্টারদা সূর্য সেনকে। তখন থেকেই বই পড়ার প্রতি বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয় সূর্য সেনের। আমাদের ভারতবর্ষের পরাধীনতার পেছনে শিক্ষার অভাব যে অনেকখানি দায়ী তা বিশ্বাস করতেন সূর্য সেন। পরে সূর্য সেন চট্টগ্রাম শহরে এসেছিলেন পড়াশোনা করতে। বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গাঢ় হতে শুরু করে পড়াশোনার সময়। ছাত্র সূর্য সেনের হাতে এসেছিল মারাঠি লেখক সখারাম গণেশ দেউস্কর-এর ''দেশের কথা''। একটু একটু করে একটা স্বপ্ন জন্ম নিচ্ছে তখন। মাস্টারদার অন্তরে।
যদিও সূর্য সেন তখনও পর্যন্ত 'মাস্টারদা' হয়ে ওঠেননি। ‘দেশের কথা’ পড়ে মাস্টারদার মনে হয়েছিল স্বাধীন ভারতবর্ষের স্বপ্ন তখনই পূর্ণ হবে, যখন প্রত্যেক ভারতবাসীর অন্তরে প্রকৃত শিক্ষা থেকে সেই ইচ্ছের জন্ম হবে। স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে মাস্টারদা ভর্তি হয়েছিলেন 'কৃষ্ণনাথ কলেজ’-এ। এই সময় তিনি শুরু করেছিলেন ''আনন্দমঠ'' পড়া। এই উপন্যাস তাঁর ভেতরে জাগিয়ে তুলেছিল দেশের প্রতি আত্মত্যাগের ইচ্ছা। ভাগীরথীর তীরে জেলখানার পাশে ছিল কৃষ্ণনাথ কলেজ। অধ্যক্ষ শশীশেখর বন্দ্যোপাধ্যায় পড়াতেন উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ। গিবনের "দ্য ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল অব দ্য রোমান এম্পায়ার" পড়েছিলেন মাস্টারদা। বিপ্লবী জন মিচেলের আত্মত্যাগের কাহিনী, ইস্টার বিদ্রোহের কথা মাস্টারদাকে উদ্বুদ্ধ করেছে। তিনি দেশের সেবায় ধীরে ধীরে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। বন্যা বিধ্বস্ত এলাকায় ছুটে গেছেন।
শিক্ষক হিসেবে পড়ানো শুরু করে ছাত্রদের খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন ‘মাস্টারদা’ সূর্য সেন। খুব অল্প সময়ই সূর্য সেন থেকে সকলের প্রিয় মাস্টারদা হয়ে ওঠেন। ছাত্রদের বারবার বলতেন গতানুগতিক বইয়ের বাইরেও অনুপ্রেরণামূলক কাহিনী পড়ার কথা। তিনি জানতেন যুবক-যুবতীদের দেশের কাজে নিয়োজিত করতে গেলে তাদের বই পড়ার অভ্যেস গড়ে দেওয়া বড় জরুরি।
মাস্টারদার গুপ্ত আস্তানায় ‘ভারতী’ পত্রিকা আসত রোজ। শরৎচন্দ্রের 'পথের দাবী' প্রকাশিত হচ্ছিল সেখানে। অপেক্ষা করে থাকতেন মাস্টারদা এই পত্রিকার। রাত জেগে শেষ করেছিলেন ‘পথের দাবী‘ পড়া। ১৯২৬ সালের ৮ই অক্টোবর গ্রেপ্তার হন মাস্টারদা। তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় রত্নগিরি জেলে। সেখানে মাস্টারদা তাঁর জীবনে এই উপন্যাসের প্রভাব বারবার স্বীকার করেছেন। তিনি বলতেন মহৎ সাহিত্য মনকে সজীব রাখে। ভালোর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে দেয় বই।
বিয়ের পর প্রথম রাতেই সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী পুষ্পকুন্তলা দেবীকে মাস্টারদা নিজের স্বপ্নের কথা জানিয়েছিলেন। চলে গিয়েছিলেন বিদায় নিয়ে। কিন্তু স্ত্রীকে নিয়মিত বই পাঠাতেন। মাস্টারদার পাঠানো বইয়ের মাধ্যমে পুষ্পকুন্তলা দেবী খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর স্বামীকে। তিনি বলতেন স্ত্রী কি ছাত্রী হতে পারে না!
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের পর ব্রিটিশ সরকারকে অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে গ্রেপ্তার করতে হয়েছিল মাস্টারদাকে। ব্রিটিশ সরকার তখন মরিয়া হয়ে উঠেছে সূর্য সেনকে গ্রেপ্তার করার জন্য। তাঁরা ঘোষণা করে দিয়েছেন দশ হাজার টাকা পুরস্কার। জীবিত বা মৃত মাস্টারদা সূর্য সেনকে গারদে পোরাই ছিল ব্রিটিশ সরকারের লক্ষ্য। ধরা পড়ার পর তাঁর ওপর অমানুষিক অত্যাচার চালানো হয়েছিল। জেলে মাস্টারদার সঙ্গী ছিল চারটে বই। 'গীতা', 'চণ্ডী' 'মহাভারত' আর রবীন্দ্রনাথের 'চয়নিকা'। জলধর সেন, প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় এবং অনুরূপা দেবী রচিত বইও পড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন জেলে বসেই। জীবনের শেষ দিনে কখনো কখনো মৃত্যুচিন্তা গ্রাস করেছে মাস্টারদাকে।
তবে ভয় পাননি। শুধু স্বাধীন ভারতবর্ষের স্বপ্নের প্রদীপ যেন জ্বলতে থাকে মানুষের মনে, এটুকুই চেয়েছিলেন। তিনি বলতেন গীতায় মৃত্যুকে পুরনো জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করে নতুন বস্ত্র গ্রহণ করা হিসেবে দেখানো হয়েছে, মৃত্যু ঠিক তেমনি। অসীম,অনন্ত, অথচ সুন্দর । মাস্টারদা মনে করতেন বই পড়ে উপলব্ধি করতে পারলে আর মৃত্যুকে অসুন্দর বলে মনে হয় না। ভয় থাকে না মৃত্যু নিয়ে। জীবনের শেষ দিকে চিঠিতেও ব্যক্ত করেছেন মৃত্যুর প্রতি অনুভূতি। "মৃত্যু আমার দরজায় করাঘাত করছে। মন আমার অসীমের পানে ছুটে চলেছে। এই আনন্দময় পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আমি তোমাদের জন্য কী রেখে গেলাম, মাত্র একটি জিনিস, তা হল আমার স্বপ্ন, স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন।"