জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি বরাবরই সাংস্কৃতিক আবহে পরিমণ্ডিত। সমাজের উন্নতিতে তারা সবসময়ে আগে অংশগ্রহন করেছেন। গোপাল উড়ের যাত্রা তখন রমরমিয়ে চলছে কলকাতাতে। সেই যাত্রাপালা দেখতে হাজির ছিলেন ঠাকুর পরিবারের ছেলেরাও। কিন্তু যাত্রা দেখে তাদের মন ঠিক ভরলো না। তাদের মনে হল নাটক হলে বেশ হত। তখন ঠাকুর পরিবারের ছেলেরা ভাবলেন নিজেরাই নাটক করবেন। কিন্তু নাটক করার জন্য হলের দরকার। তাঁরা ঠিক করলেন জোড়াসাঁকোতেই একটা নাট্যশালা গড়ে তুলবেন। যেই ভাবলেন সেই কাজ শুরু করলেন। নাট্যশালার কথা শুনেই হাজির হলেন তাদের বন্ধু বান্ধব আত্মীয়রা। অক্ষয় চৌধুরী, কৃষ্ণবিহারি সেন, রবীন্দ্রনাথের বড় দিদি সৌদামিনীর স্বামী সারদা প্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় কমিটি অফ ফাইভ গঠন করে জোড়াসাঁকো নাট্যশালা প্রতিষ্ঠা করে ফেললেন। আবার দরকার নাটকের| নাটক ছিল মধুসূদন দত্তের নাটক 'কৃষ্ণকুমারী' এবং 'একেই কি বলে সভ্যতা'? এই দুটি নাটক নিয়েই শুরু হল রিহার্সাল। বেশ কয়েক মাস ধরে চললো রিহার্সাল। তার পরে বেশ অনেকবার হল নাটকের অভিনয়। এবার চাই নতুন নাটক এই নাটক পছন্দের ব্যাপারে অত্যন্ত খুঁতখুঁতে গনেন্দ্রনাথ। ডাকা হল ওরিয়েন্টাল সেমিনারির প্রধান শিক্ষক ঈশ্বর নন্দীকে। তিনি নাটকের বিষয় নির্বাচন করে দিলেন। সেই সময়টা ছিল উনিশ শতক স্ত্রী শিক্ষা, স্বাধীনতা ও পুরুষদের বহু বিবাহ নিয়ে উত্তাল সমাজ।
ঈশ্বর নন্দী নির্বাচন করেন পুরুষদের বহু বিবাহ কে। সঙ্গে সঙ্গে কাগজে কাগজে বিজ্ঞাপন ছেপে গেল। সে সময়ের সব থেকে বড় পন্ডিত রামনারায়ণ তর্করত্ন লিখে দিলেন বহু বিবাহ কুপ্রথা নিয়ে নাটক 'নবনাটক'। নবনাটকের রিহার্সাল চলল বৈঠকখানা বাড়ির দোতলায়, স্টেজ বাঁধা হল। এই নাটকের রিহার্সাল চলল সাত থেকে আট মাস ধরে। জানুয়ারি মাসের এক সন্ধ্যায় জোড়াসাঁকো নাট্যশালায় নবনাটক এর প্রথম অভিনয়। নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার দিন ঠাকুর বাড়ি সাজানো হল আলো দিয়ে। অথিতিদের আনাগোনা। এই অনুষ্ঠানে প্রবেশ ছিল না শুধু শিশুদের। কিন্তু ছোট রবি ও অন্যান্য শিশুরা বারান্দা রেলিং এর ফাঁক দিয়ে উপভোগ করতো এই আনন্দ। নাটকে নট রূপে অভিনয় করলে গুণেন্দ্র ভগ্নী কুমুদিনির স্বামী নীলকমল মুখোপাধ্যায়। তখন ঠাকুর বাড়ির মেয়েদের মঞ্চে অভিনয় করার অনুমতি ছিল না। তাই নটি সাজলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। গনেশ বাবুর চরিত্রে অভিনয় করলেন অক্ষয় মজুমদার। গনেশ বাবুর তিন স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করলেন নীলকমল মুখোপাধ্যায়, মনিলাল মুখোপাধ্যায়, বিনোদ গাঙ্গুলি। নাটকটিকে বাস্তবধর্মী করার জন্য গুনেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ উঠে পড়ে লাগলেন। নাটকে বনের দৃশ্য কে বাস্তবধর্মী করে তোলার জন্য গুনেন্দ্রনাথ নিজের হাতে তৈরী বাগান থেকে গাছ পালা তুলে এনে তা সাজিয়ে বনের অন্ধকার পথ বানালেন। বাড়ির মালিকে দিয়ে আনালেন জোনাকি পোকা। যাতে বনের দৃশ্য এলেই জোনাকি পোকা ছেড়ে দেওয়া যায়। আর ফলে দৃশ্যটি তৈরী হল বাস্তবধর্মী। নবনাটকটি জোড়াসাঁকোঠাকুর বাড়িতে পর পর নয় দিন মঞ্চস্থ করা হল ব্যাপক ভাবে সাড়া ফেললো এই নাটকটি।