শিল্পীকে প্রাপ্য সম্মানের সিকি ভাগও দিতে পারেননি নিজের লোকেরা। অথচ একটা বাচ্ছা মেয়ে নালিশ জানিয়েছিল। শিল্পীর কাছেই শিশু মনের আবেগঘন জিজ্ঞাসা - তাঁর ঠাকুর ঘরে কেন লোক জুতো পায়ে প্রবেশ করেন! ঠাকুর ঘর অর্থে শিল্পীর ধ্যানের জায়গা। তাঁর সৃষ্টির কুঠুরি।
বয়স তখন তিরিশের ঘরে। কালীঘাট মন্দির চত্বরে পাইচারি চলছে। তরুণ শিল্পীর নজর কাড়লো এক নতুন শিল্প মাধ্যম। নতুন রং তুলির মোহে আবদ্ধ হলেন সেই। সেই মোহই তাঁকে দেবে বিশ্ব নন্দিত খ্যাতি। এতদিন ক্যানভাসে সাজিয়েছেন ‘ইম্প্রেশনিজম’ এবং ‘কিউবিজম’ এর অনেক গল্প। অথচ সারল্যে ভরা এই নতুন চিত্র শিল্পন তাঁকে গ্রাস করে মুগ্ধতা ভরে। আঙুলে শিল্পের বর নিয়ে জন্মেছিলেন। বাংলার এক লাল মাটির গ্রামে জন্মেও রক্তে পেয়েছিলেন পাশ্চাত্যের প্রতীতিবাদের ঘরানা। পোট্রেইট, ল্যান্ডস্কেপ, তৈলচিত্র। প্রত্যেকবারই অনন্য তিনি। অনুসরণে ছিল গগা, গঘের স্টাইল। সেই স্টাইলে মিশিয়েছেন নিজের ঢং।
উত্তর কলকাতার এক বাড়ির রোয়াকে বসে লিথোগ্রাফির কাজ করেছেন। সঙ্গী ও দর্শক পাড়ার ঠিকে ঝি’রা! ‘সীতা’ নাটকে স্টেজের ‘সিন’ এঁকেছেন। এঁকেছেন দোকানের টিনে। শ্যামবাজারে কাপড়ের দোকানে শাড়ি কেনাবেচা করতে গিয়ে বুঝে গিয়েছিলেন নানা পেশার মানুষের রঙের পছন্দ-অপছন্দ! শিল্পত্বের খোঁজেই কলকাতা গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে আসা। সেখানে তখন অধিষ্ঠান করছেন ভারতের আধুনিক চিত্রকলার আরেক প্রাণপুরুষ, স্বয়ং অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বেশি সময় লাগেনি দুই কিংবদন্তীর কাছাকাছি আসতে। গুরুর বীক্ষাতেই অন্তরদর্শন লাভ হল। নিজেকে প্রশ্ন করলেন, কেন বিদেশী রীতির অনুসরণ করা!
ক্রমেই বদলাতে থাকে আঁকার বৈশিষ্ট্য, ধরন, বিষয়বস্তু, তুলির ব্যবহার। নিজের ছবিগুলি সম্পূর্ণ হওয়ার পরেও জোটেনি তৃপ্তি। কিছু একটা অভাব থেকে যায় বারেবারে। আর তা ছিল শিল্পীর মাটির কথা। নিজের শিল্পে নিজের মানুষের কথা না বললে আর কীই বা আবেদন রেখে যান আগামীর কাছে। খাঁটি কালীঘাটের পটের আঙ্গিক হয়ে উঠলো তাঁর চর্চার প্রধান উপজীব্য। শুধুমাত্র কালীঘাট চিত্রকলাতেই থেমে থাকলেন না। জন্মস্থান বেলিয়াতোড়, ওড়িষ্যা, পুরনো গুজরাট, মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম থেকেও সংগ্রহ করেন পট। পুরাণ, ধর্ম, পশুপাখি। এগুলোই স্থানীয়রা নিজস্ব রঙে-ঢঙে আঁকতেন, যা কালীঘাট চিত্রকলা নামে বিখ্যাত ছিল।
গ্রামীণ জীবন-জীবিকা, লাঙল হাতে চাষী, কীর্তন গায়ক, কিশোরী কন্যাদের হাসি, ঘরোয়া বধূ, বাঁশীবাদক ক্লান্ত পথিক, নৃত্যরত তরুণীদ্বয়, বাঘ, মাছ, বিড়াল, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রভৃতি হলো তার অঙ্কনের বিষয়াদি। পটচিত্রের উপাদানে আরও রসদ যুগিয়েছে প্রিয় ধর্মকাহিনীগুলো। বাঙালির দেওয়ালে, সস্তার নড়বড়ে বাঁধাইয়ে, ডেস্ক-ক্যালেন্ডারে, নতুন বছরের শুভেচ্ছাবার্তার ছবিতে, বিয়ের কার্ডে, মেলায়। এই তালিকা দীর্ঘ। কোথায় নেই তিনি?
তিনি যামিনী রায়। স্পষ্ট। দৃঢ়। সহজ এক মানুষ। ঋতুর পর ঋতু ছবি আঁকেন। ভাবেন। কেউ এলে কথা বলেন ছবি নিয়ে। মাটির কাছাকাছি নয়, মাটিতেই বাঁচা। আর এই বিশ্বাসেই এগিয়ে চলা। কিশোর বয়স কেটেছে গ্রামের প্রতিমা শিল্পীদের কাজ, কাঁথার বুনন, উৎসবে দেওয়া আলপনার নকশার সঙ্গে।
কারিগর, ছুতোর, কুমোর, পটুয়াদের কাজ কাছ থেকে দেখাটাই শিল্পের ভিত গড়ে দিয়েছিল। ছবি আঁকা-শেখার পাশাপাশি অল্প বয়স থেকেই চলেছে রুটি-রুজির সন্ধান। কত বিচিত্র কাজ যে করেছেন! দাদার বইয়ের ব্যবসা। দোকানে বই পৌঁছে দিয়ে মিলত আনা চারেক। ইহুদি ব্যবসায়ীর অর্ডারি কার্ড কার্ড আঁকলে দশ-বারো আনা। তাতে যোগান হত এক প্লেট ভাতের।
ধ্রুপদী পাশ্চাত্য স্টাইলে শিক্ষিত হলেও ধীরে ধীরে সেখান থেকে সরে এসে গ্রামবাংলার লোকশিল্পে আশ্রয় নেন তিনি। পাল্টে ফেলেন শিল্পচর্চার মাধ্যমও। অয়েল পেন্টিংয়ের বদলে লোকশিল্পীদের ব্যবহার করা মাধ্যমেই ফিরে যান রায়। কালিঘাট পটশিল্পের মতোই তুলির বড় বড় টানে আঁকতে থাকেন একের পর এক ছবি।
গত শতকের চল্লিশের দশকে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে তাঁর নাম পৌঁছে যায় ইউরোপীয় মানুষজনের ঘরে ঘরে। লন্ডন-নিউ ইয়র্কের শিল্পরসিকদের মুখে মুখে চর্চিত হয়েছেন তিনি।
দেশপ্রেমে অবিচল যামিনী রায়, একাধিকবার সুযোগ পেলেও যাননি বিদেশে। আমরা গরিব দেশের মানুষ, এত পয়সা খরচ করে ওদের দেশে যাব কেন? ওদের অনেক পয়সা। ওরা এসে আমাদের দেখে যাক।
বাঙালির মননে যাপনে আছেন তিনি। ছোট্ট শিশু বেড়ে ওঠে মাথার উপরে উরন্ত ক্যালেন্ডারে তাঁরই শোভা পেয়ে। শিল্প যখন আত্মার খোঁজে বিলীন হয়ে সৃষ্ট; শিল্পী যখন আত্মহারা নিজের ছন্দ যাপনে - প্রত্যেকবার ফিরে ফিরে আসেন তিনি, যামিনী।
এমন এক মাটির শিল্পীকে আজ তাঁর জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য।