জন্মের সময় ধাত্রী ভেবেছিলেন মৃত শিশুর জন্ম হয়েছে। একটি টেবিলের ওপর শিশু শিল্পীর নিথর দেহ রেখে মায়ের সেবা-শুশ্রুষায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। এগিয়ে আসেন কাকা। মুখের সিগারেটের ধোঁয়া যেতেই হাত পা নাড়েন শিশু। প্রথম উচ্চারণ করেছিলেন পিজ। লাপিজ শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ। মানে পেন্সিল।একটা ক্যানভাস। ঐতিহাসিক বটে। লেগে রয়েছে রক্ত মাখা ইতিহাস। রঙের আধিক্যে আবার সাদা-কালো।
শুধু ধ্বংস আর তাকে ঘিরে মানুষের চিৎকার। এক মা এগিয়ে আসছেন, হাতে আলো। কিউবিজমের বীজ পুঁতেছেন এরও আগে। ছবির নাম গোয়ের্নিকা। কিন্তু শিল্পী নিজেকে স্রষ্টা মনে করতেন না। বলা হয়, স্টুডিও তে কিছু সৈনিক আচমকা ঢুকে যান। শিল্পী কে তারা প্রশ্ন করলেন, ‘ কে করেছে? ’ উত্তর এলো, ‘ তোমরা। ’
আর্টের বিভিন্ন মাধ্যমে ছিল অগাধ যাতায়াত। অবজার্ভেশন ক্ষমতা ছিল সহজাত। ছেলেবেলা থেকেই আঁকার খাতায় হাতের নড়া চড়া। তখন ছিলেন ওল্ড মাস্টার। বড় হয়ে হতে পেরেছেন শিশু। শিশুদের মতো। নিজের আঁকার দৃষ্টিভঙ্গি ও সারল্য নিয়ে এই ছিল স্টার এর মতামত। বাস্তববাদীরা উপেক্ষিত। তাই তাঁদেরও উপেক্ষা করতে হয় ছল বাস্তবকে। রিয়ালিজ্মের মূল জায়গাটাকে তিনি তখনই ধরতে পেরেছিলেন।
তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য হরমোন দের আধিপত্যও স্বাভাবিক হারে বেড়েছে। আয়ত্ত করেছেন মানুষের মুখ, চেহারা, ল্যান্ডস্কেপ তাঁর ছবি গুলোতে তাঁরই না বলা কথা গুলোর ভাষা। নন্দনতত্ত্ব তাঁর প্রতিটি ছবির ভিত্তি। চলে এলো ‘ব্লু পিরিয়ড’। এক বন্ধু আত্মহত্যা করেছেন। দারিদ্র্যতা ঘিরেছে। রেস্তোরাঁয় খেতে আসা ছেঁড়া গরিব মানুষের কথা বললেন। নীল রঙে চোবানো ছবিটা দেখিয়ে দিয়েছিল রোমান্টিসিজমের নতুন আঙ্গিক। প্রতিষ্ঠিত হলো আগামীর এক কিংবদন্তীর। যাঁর নাম, পাবলো পিকাসো।
এক সময় মজলেন সার্কাস নিয়ে। বিষয়বস্তু। মিডিয়ামের ভাঙ্গা গড়া নিয়ে নিজেকে হারিয়েছেন বারেবারে, প্রত্যেকবার নতুন তরে। আর সেখানেই পিকাসো আলাদা। আঁকার বিষয়বস্তু নিয়ে ভাবতেন না কখনই। সঠিক সময়ে তারাই দরজার কড়া নাড়ত। ফিগার ড্রইং এবং তৈলচিত্রের আনুষ্ঠানিক হাতেখড়ি চিত্রশিল্পী বাবার কাছেই। লেস ডেমোঁয়সেলেস ডি’এভিগনন। দ্য ইয়ং লেডিস অব এভিগনন। পাঁচ নগ্ন নারী পতিতা। ক্যানভাসে মুখোমুখি। কৌণিক এবং অসংযুক্ত দেহের গঠনে। না ছিল চেনা ছকের কোনও বাদ - এর রূপক, আর না ছিল স্বাভাবিক বিক্ষোভ।
গোয়ের্নিকা ছবির অন্যতম প্রটাগনিস্ট মৃত শিশু হাতে এক মা, এক নারী। অন্য এক ছবির সার হয়ে ওঠেন তিনি। দ্য উইপিং ওম্যান। ভয় এবং কষ্ট বোঝাতে বিকৃত মুখ, চাপা কান্না, চিৎকার করা নীল দাঁত এবং বেরিয়ে আসা কালো চোখগুলো নারীরা অন্য রূপের প্রতিষ্ঠা করেছে। যে রূপে সচরাচর পুরুষ তাঁকে দেখেননা। পাবলো রুইজ ই পিকাসো একটি স্পেনীয় নাম। প্রথম নাম রুইজ, দ্বিতীয় নাম পিকাসো। মাঝে বাবার নাম হোসে রুইজ ব্লাসকো। আর মা মারিয়া পিকাসো লোপেজ।
একজন ভাস্কর, প্রিন্টমেকার, মৃৎশিল্পী, মঞ্চ নকশাকারী, কবি এবং নাট্যকার। এক দেহ এত প্রাণ। ৯১ বছর পর্যন্ত বইতে পেরেছিলেন ওই ভার। ছোট্ট শিশুকে কানমোলা দিয়ে মৃত্যু ডেকে নিল। আজ শিল্পীর স্মরণ দিবস, আনুষ্ঠানিক মতে। তবে পিকাসো কে স্মরণ করতে লাগেনা। তিনি স্মরণে বরাবরই থাকেন। প্রত্যেক মানুষেরই। কারণ প্রত্যেক মানুষ তাঁকে জুগিয়েছে অনুপ্রেরণার জুঁই ফুল।
প্রত্যেকেরই আত্মা আছে। শরীরের ভিতরে তাঁর বাস। অনেক ভিতরে। রোজের দুঃখ - কষ্ট, পাওয়া - নাপাওয়ারা সেখানে ধুলো ওড়ায়। সেই লেগে থাকা ধুলোয় শিল্পের ছিটে দিতেই আর্টের প্রয়োজন। বিশ্বাস করতেন তিনি।