যাই বলুন, অসুরেরা কিন্তু বড্ড ভুঁইফোড় জীব মশাই! যথা-তথা যখন-তখন সুযোগ পেলেই তারা গজিয়ে ওঠে। হঠাৎ একদিন নতুন এক অসুর সেভাবেই জন্মে গেল। জল থেকে। আর জল থেকে জন্মাল বলেই বোধহয় ধুরন্ধর জ্ঞাতিগুষ্টিরা তার নাম দিয়ে দিল, 'জলন্ধর'। তা না হয় হল, কিন্তু তারপর ব্যাটাচ্ছেলে কী করল? ওমা কী আবার, অসুরের যা কাজ, তাই! জগৎজুড়ে তাণ্ডব চালাবে বলে ব্রহ্মাকে ভজিয়ে তাবড় একখানা বর বাগাতে ঘোর তপস্যা শুরু করল।
হক কথা হচ্ছে, বরটর বাগাতে অত অত দেবতাদের মধ্যে অসুরদের প্রথম পছন্দ কিন্তু ব্রহ্মাই। হবেন না-ই বা কেন? তিনি যে পাকামাথার লোক! কাজেই ভীমরতিও তাঁর যথেষ্ট। হাজারটা বছর তপস্যা টেনে দিতে পারলেই কেল্লাফতে। বুড়োবাবা গলে একেবারে জল! জলন্ধর সেই ছকে খেলে ত্রিলোক বিজয়ের বর হাসিল তো করলই, এমনকি দেব-মানব-দৈত্য কেউই তাকে মারতে পারবে না-এমনধারার মোক্ষম বরটিও হাসিল করে ছাড়ল। বর দিয়ে প্রজাপতি কী ঝকমারীটি যে করলেন, সেটি বোঝা গেল তার পরই! জলন্ধর স্বজাতীয় মূর্তি ধরে পাতালের একছত্র অধীশ্বর তো হলই, মর্ত্যলোকও ছারখার করে ছাড়ল। দু’দুটো লোক গোল্লায় পাঠিয়ে শুরু হল তার আসল খেলা! আকাশছোঁয়া আকার ধরে কয়েক লক্ষ কদাকার দৈত্য নিয়ে ভয়ঙ্কর সব অস্ত্র উঁচিয়ে সে দেবলোক আক্রমণ করল।
দেবরাজ ইন্দ্র যে সহজেই পরাজিত হতে আর পালিয়ে গিয়ে ত্রিদেবের সাহায্য ভিক্ষা করতে ওস্তাদ-এটা ত্রিলোকের সব্বার মুখস্থ। এক্ষেত্রেও তিনি সেটাই করলেন। প্রধান দেবতারাও পালিয়ে গেলেন। ফাঁকতালে জলন্ধর অপ্রধান দেবতাদের আর প্রধান গন্ধর্ব-অপ্সরাদের ফটাফট বন্দি করে ফেলল। শচীকেও সে নিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু, ইন্দ্র আকুলিবিকুলি করে প্রায় জলন্ধরের হাতেপায়ে ধরার উপক্রম করলেন। আহা রে, বেচারার সিংহাসন গেছে, অপ্সরাসুন্দরীরাও বেহাত হয়েছে; বউ গেলে কী নিয়ে থাকবে লোকটা! এমনভাবের বিচকুটে হেসে জলন্ধর ক্ষমাঘেন্না করে শচীকে ছেড়েই দিল।
ত্রিদেবের মধ্যে ব্রহ্মা বিপদ বাঁধাতে যতটা দড়, আপদকালে অস্ত্র নাচানোয় ততটাই নাচার। ওসব যুদ্ধটুদ্ধ তাঁর ধাতে একেবারেই সয় না। এক্ষেত্রে হাত উল্টে বসে থাকাই তাঁর স্বভাব। দেবরাজসহ দেবতারা তবু তাঁর পাকামাথাটির খাতিরেই বিপদ উদ্ধারের বুদ্ধি চেয়ে ধন্না দিলেন। ব্রহ্মা তবু মাথা খাটালেন না। তাঁর আদি ও অকৃত্রিম দুটি ফিকির আছে--‘চলো বিষ্ণুর কাছে, চলো মহাদেবের কাছে!' তাতেই তিনি ভিড়িয়ে দিলেন দেবতাদের।
দেবতারা বৈকুণ্ঠে এলেন। শরণ নিলেন বিষ্ণুর। তাদের কাকুতিমিনতিতে রাজি হয়ে জলন্ধরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামলেন গরুড়বাহন বিষ্ণু। কিন্তু, তখন বিষ্ণুর হাতে অস্ত্র বলতে কেবলমাত্র গদা। তাই দিয়ে আর কতটুকু-কীই বা করা যায়! দু’য়েক কিস্তির পর বাহনশুদ্ধ বিষ্ণুকে নাগপাশে অবলীলায় বেঁধে বন্দি করে ফেলল জলন্ধর। বিষ্ণু হেরে গেলেন। আর বিষ্ণুকে হারাতে পেরেই জলন্ধরের আস্ফালন দ্বিগুণ হয়ে গেল! সে ভাবল, দেবকুলে বাকি তো আছেন শুধু মহাদেব, এবার হয়ে যাক তাঁর সঙ্গে একহাত। তাঁকে হারাতে পারলেই সেও হবে পরমেশ্বর!
যেমন ভাবা তেমন কাজ, হাজির হল গিয়ে সে একেবারে কৈলাসে। হেন করেঙ্গা তেন করেঙ্গা পঞ্চাশ রকমের গা জ্বালানো কথা বলে মহাদেবের ধ্যান ভাঙিয়ে সরাসরি যুদ্ধের জন্য উত্তেজিত করতে লাগল সে। তার বিচকুটে কথায় মহাদেবের খুব রাগ হল, আর তাতেই তাঁর তৃতীয় নয়ন খুলে গেল। সেই নয়ন থেকে বেরিয়ে এলো বিধ্বংসী আগুন, সেই আগুনেই জলন্ধরের সঙ্গে দৈত্যদানো রথটথ যা ছিল সব মুহূর্তেই পুড়ে ছাই হয়ে গেল। তবু ব্যাটার দেমাক গেল না! মহাদেবকে হাতাহাতি করার জন্য কষে হাঁকাহাঁকি করতে লাগল, তার চোখে পরমেশ্বর হবার অন্ধ আকাঙ্ক্ষা!
মহাদেব সর্বজ্ঞ ঠাকুর, তিনি জানেন ব্যাটাকে হাতাহাতি করে হবে না, বুদ্ধি করে গাড্ডায় ফেলতে হবে। সে-কথা ভেবেই তিনি করলেন কী, পায়ের আঙুল দিয়ে সামনের হ্রদের জলে একটা চক্র আঁকলেন; তারপর জলন্ধরকে বললেন যে, এই চক্র যদি সে জল থেকে তুলে আনতে পারে, তাহলে তিনি তার সঙ্গে লড়াই করবেন, নতুবা নয়। এই টুকু যে পারবে না, তার সঙ্গে আর লড়াই কীসের! ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেই অসুরদের মাথা এমন গরম হয়ে যায় যে, আর হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। ফলে, ক্ষমতা জাহির করতে রেগেমেগে জলন্ধর জলে নেমে পড়ল। অনেক চেষ্টার পর অসম্ভব ভারি সেই চক্র কোনরকমে ঘাড়ে তুলেও ফেলল। সেটা ঘাড়ে নিয়ে দম্ভ দেখিয়ে দন্ত বিকশিত করে হাসতে হাসতে সে যেই না পাড়ে এসে উঠেছে, অমনি চক্রটা ভারি হতে হতে সোনার হয়ে গেল, তা থেকে ঠিকরে বেরোতে লাগল যেন হাজার সূর্যের আলো এবং তা দুরন্ত গতিতে ঘুরতে শুরু করল। চক্র ঘাড়ের ওপর থাকায় জলন্ধরের মুণ্ডুটিও কচাত করে কাটা গেল। এতেই জলন্ধর মরে গেল। কেউ তাকে মারল না, পাকে পড়ে চক্রে মারা গেল সে। তখন চক্র গেল জলে আর জলন্ধরের কন্ধকাটা শরীর গেল নরকে। কবন্ধ থেকে বেরোনো রক্ত দিয়ে নরকে তৈরি হল, রক্তকুণ্ড। নরকে তেমন তেমন পাপীদের সেই কুণ্ডেই এখন চোবানো হয়!
জলন্ধর নিকেশ হতেই আসরে নামল ধুন্ধু নামের এক অসুর। নিজের ধুন্ধুমার ক্ষমতায় সে পটাশ করে ত্রিলোক জয় করে ফেলল। দেবতাদের সমস্ত অস্ত্রই বিফল হল, কোন কিছু দিয়েই তাকে বধ করা গেল না। পরাজিত দেবতারা প্রতিবারের মতো ব্রহ্মার কাছে গিয়ে হত্যে দিলেন, ব্রহ্মাও তাঁদের নিয়ে গেলেন বিষ্ণুর কাছে। সব শুনে বিষ্ণু বললেন যে, গদাযুদ্ধে জলন্ধরের সঙ্গে তাঁর অভিজ্ঞতা মোটেই ভালো না। ধুন্ধুকে ধুয়ে ফেলতে একখানা মোক্ষম অস্ত্র তাঁর চাই, জলন্ধর বধের সময় মহাদেব সোনার যে চক্রটা নির্মাণ করেছিলেন, সেটা পেলে ধুন্ধুকে তিনিও একহাত দেখে নেবেন!
কিছু পেতে গেলে সাধনা করতে হয়। ফলে, আয়োজন হল শিবসাধনার। আদেশ পেয়ে বিশ্বকর্মা শিবলিঙ্গ তৈরি করে দিলেন। সেই লিঙ্গ ঘি-মধু-দুধ দিয়ে ধুইয়ে বিষ্ণু তাতে হাজারখানা পদ্ম শিবের হাজার নামের মাহাত্ম্য গাইতে গাইতে উৎসর্গ করতে শুরু করলেন। ভক্তকে ছলনা করতে শিব একটি ফুল লুকিয়ে ফেললেন। পরমভক্ত বিষ্ণুও কম যান না, তিনি আসন ছেড়ে উঠলেন না। রামচন্দ্রের মতো ফুলের অভাব মেটাতে পদ্মের মতো সুন্দর নিজের একটি চোখ উপড়ে অঞ্জলি দিলেন। পুজো শেষ করলেন। তখন শিব তুষ্ট হয়ে কয়েক হাজার সূর্যের তেজ নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন। বর দিলেন যুদ্ধে জয়ী হবার। এই ফাঁকে বিষ্ণু যুদ্ধের জন্য তাঁর সোনার চক্রটি চেয়ে বসলেন। এতে তুষ্ট শিব খুশিই হলেন। তিনি আহ্বান করতেই সামনে হাজির হল সেই সুন্দর দর্শন সুবর্ণ চক্র। শিব সেই চক্রের নাম দিলেন, ‘সুদর্শন’। তারপর তা নিজের হাতে বিষ্ণুকে দান করলেন চিরদিনের জন্য। এরপরই শিব ভয়ানক এক রুদ্ররূপ ধারণ করলেন। বিষ্ণুকে বললেন, ওহে বিষ্ণু, যুদ্ধ জয় করতে হলে তোমাকেও এমন রুদ্ররূপ ধরতে হবে। শান্তশিষ্ট ভাব নিয়ে যুদ্ধ করতে গেলে যুদ্ধ জেতা যায় না। শান্তভাব ভক্তের জন্য, রুদ্ররূপ শত্রুর জন্য। সেই রূপেই শত্রু অর্ধেক ঘায়েল হয়, বাকিটা অস্ত্রের কাজ! মনে পালনকর্তার মায়া রাখলে আর যাই হোক, যে শত্রুর শেষ রাখতে নেই, তাকে দমন করা যায় না!
শিবের উপদেশ আশীর্বাদের মতো মাথায় নিয়ে বিষ্ণু রুদ্ররূপ ধরে যুদ্ধ করতে গেলেন ধুন্ধুর সঙ্গে। প্রথম থেকেই তিনি তেড়ে সুদর্শন চালিয়ে সৈন্যসমেত ধুন্ধুকে কচুকাটা করে ফেললেন। সুদর্শনের জন্য অনায়াসেই যুদ্ধ জয় করে ফেললেন তিনি। এভাবেই তাঁর পরম সঙ্গী হয়ে উঠল এই মোক্ষম অস্ত্র, হয়ে উঠল তাঁর হাতের শোভা। ভক্তের বন্দনাগানে তাঁকে বিশেষিত করা হতে লাগল, শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারীরূপে।
গল্পসূত্রঃ বেদব্যাস রচিত, 'লিঙ্গপুরাণ'।