কাচের শো-কেসের ওপর পেল্লাই সাইজের এক রঙ্গিন হাঁড়ি। সরা দিয়ে মুখ বন্ধ। ভিতরে অমৃতের স্বাদ।
মিষ্টির দোকানে ক্রেতার ভিড় জমাতে শুধু ‘জয়নগরের মোয়া’ এটুকু নামই যথেষ্ট। শহর এবং শহরতলীতে শীতের আমেজ আসতে শুরু করলেই শীতের স্পেশাল মিষ্টির দোকান গজিয়ে ওঠে। গুড় পাটালীর সঙ্গে থাকলেও প্রধান আকর্ষণ কিন্তু জয়নগরের মোয়া। মুখে দিলে মিলিয়ে যায়। আঙুলে গন্ধ লেগে থাকে।
গুড় থেকে মাখা খই, প্রজন্মের পর প্রজন্মকে মাতিয়ে রেখেছে স্বাদে। বাঙালির শীতকালের রিংটোন। নামে গুড় মাখা খই হলেও আসলে ব্যপারটা বেশ মহারাজকীয়।
মোয়া বানাতে লাগে কনকচূড় ধানের খই, ক্ষীর, নলেন গুড়।
নলেন গুড় জ্বাল দিয়ে ফুটিয়ে তাতে খই আর ক্ষীর, গাওয়া ঘি মিশিয়ে হাতের তালুতে পাকিয়ে তার ওপর খোয়া ক্ষীরের গুঁড়ো, মধু, কাজু আর কিশমিশ। মোয়ার প্রাণ অনেকটাই তার গন্ধতে। সেটাই শীতকালের অন্যান্য মিষ্টির থেকে মোয়াকে আলাদা করে তুলেছে।
মোয়ার নামের সঙ্গে জয়নগরের নাম প্রায় অবিচ্ছিন্ন হলেও মোয়ার আঁতুড়ঘর বহড়ু গ্রাম।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জয়নগরের নিকটবর্তী বহড়ু গ্রামের জনৈক যামিনীবুড়ো। শোনা যায় কোনও এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে নিজের ক্ষেতের কনকচূড় ধানের খই আর নলেনগুড় দিয়ে তৈরি সম্পূর্ণ এক নতুন ধরনের মিষ্টি খাইয়ে নিমন্ত্রিতদের চমকে দেন। মিষ্টির নাম হয় ‘মোয়া’। শীতের দিনে এমন চমকের কথা ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশের গ্রামেও।
১৯২৯ সালে জনৈক পূর্ণচন্দ্র ঘোষ ওরফে বুঁচকিবাবু এবং নিত্যগোপাল সরকার প্রথম ব্যবসায়িক ভিত্তিতে বিপনীতে মোয়া বিক্রি শুরু করেন।
পরবর্তী সময়ে মোয়ার গায়ে ‘জয়নগর’- এর নামটা পাকাপাকিভাবে লেগে যায়। হারিয়ে যায় বহড়ুর নাম।
দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার কুলপি, কাকদ্বীপ ও নামখানা অঞ্চলের প্রায় ৪০০ বিঘা জমিতে কনকচূড় ধানের চাষ হয়। পশ্চিমবঙ্গের কেবলমাত্র এই জেলাতেই কনকচূড় ধান চাষ হয়। এই ধান থেকে যে খই পাওয়া যায় তাই দিয়েই তৈরি হয় মোয়া।
২০১৬ তে বাংলার মোয়া জিআই স্বীকৃতি পেয়েছিল। তবু মোয়াশিল্পে মন্দা। খেজুর গাছ কমতে থাকা, তার অন্যতম কারণ।
নকল উপাদানে তৈরি সস্তার মোয়া বাজার দখল করে নেওয়ায় ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছিলেন আসল মোয়ার কারিগর এবং ব্যবসায়ীরা।
জিআই স্বীকৃতিও মোইয়া বাজারের মন্দা আটকাতে পারেনি। তবে নকল মোয়ার ভিড়ে যাতে আসল মোয়ার অপমৃত্যু না ঘটে তার জন্য বহুড়ায় ‘গুড়-পাটালি-মোয়া’র মেলার আয়োজন করা হচ্ছে।