দেবী জগদ্ধাত্রী দেহে জগতকে ধারণ করে ধাত্রীরূপে তাকে লালন করেন। তিনি ব্রহ্মস্বরূপিণী, কারণ ব্রহ্ম থেকেই তাঁর উদ্ভব। তাই ব্রহ্ম যেমন সমস্ত চরাচরসহ ব্রহ্মাণ্ডে ব্যাপ্ত, সমস্ত শক্তির মূল, সমস্ত কর্মের উদ্দেশ্য, সমস্ত কর্মের বিধেয়; তিনিও তেমনি। তিনি প্রবলতম নারীশক্তির প্রতীক। তিনি উমার অংশ। উপনিষদের যুগে নারী যখন প্রবলভাবে বিদ্যাবুদ্ধি, প্রজ্ঞায়, চর্যায় পুরুষকে ছাপিয়ে যাচ্ছিল; তখনই প্রতীকীভাবে দেবীর উত্থান। উপনিষদের গার্গী ও যাজ্ঞবল্ক্যের উপাখ্যানে দেখতে পাই ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য বিদুষী গার্গীর প্রশ্নের জবাব দিতে না-পেরে, তাঁর প্রজ্ঞার কাছে হেরে গিয়ে, ঋষির সংযম খুইয়ে, তাঁকে মুণ্ড খসে পড়ার অভিশাপ দিয়ে নিরস্ত্র করতে চাইলেন। আগ্রাসী পুরুষ এভাবেই খুঁজে সেদিন খুঁজে নিয়েছিল দুর্দম দমননীতি।
পুরুষের এই উপেক্ষা আর দমননীতিরই বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিস্পর্ধার একটি রূপক আমরা দেখতে পাই 'কেনোপনিষদ'-এ, দেবী জগদ্ধাত্রীর উদ্ভব-উপাখ্যানে:
অগ্নির মতো আত্মদম্ভী দেবতারা একবার ব্রহ্মকে অস্বীকার করতে চাইলেন। তাঁরা ঘোষণা করলেন, যুগে যুগে অসুরদের বিরুদ্ধে তাঁদের যে যুদ্ধ হয়েছে, তাতে জয়ের সমস্ত কৃতিত্ব একমাত্র তাঁদেরই! তাঁরা প্রচার করতে লাগলেন যে, নিজেদের বাহুবলেই এতদিন তাঁরা জিতেছেন, ভবিষ্যতেও জিতবেন! এই ধরণের কথা শুনে, ব্রহ্ম স্মিত হাসলেন। অবোধ ঔদ্ধত্যের জন্য দেবতাদের ক্ষমা করলেন। স্বয়ং এলেন তাঁদের কাছে, সত্যপথ দেখিয়ে দেবার জন্য। তিনি তাঁদের অহং বিনষ্ট করার জন্য সামনে রাখলেন একটি ঘাসের টুকরো। বললেন, টুকরোটিকে সরিয়ে দিতে। দম্ভী দেবতারা তখন অহংকারে অন্ধ। সামান্য ঘাসের টুকরো সরানোর আহ্বান তাঁদের কাছে নিতান্তই বালখিল্য বলে মনে হল। বিকৃতবিভঙ্গে হাসতে হাসতে ব্রহ্মকে তাঁরা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে লাগলেন। ব্রহ্মর ঠোঁট থেকে স্মিত হাসি তবু সরল না। এমনকি পূর্ব-আহ্বান থেকেও তিনি সরে দাঁড়ালেন না। তখন দেবতারা ব্রহ্মকে বোকা প্রমাণ করতে তৎপর হলেন। তাচ্ছিল্য করতে করতে প্রথমে এগিয়ে এলেন অগ্নি, তিনি তাঁর লেলিহান আগুনে ঘাসের টুকরোটিকে ছাই করে দিতে চাইলেন নিমেষে। পারলেন না। তখন পবন এলেন প্রবল হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে। কিন্তু, তিনিও পারলেন না। বরুণ এলেন, চাইলেন উত্তাল জলস্রোতে ভাসিয়ে দিতে। হ্যাঁ, তিনিও ব্যর্থ হলেন। তবু তাঁরা ব্রহ্মকে চিনতে পারলেন না। রাগে অন্ধ হয়ে ব্রহ্মকেই বিনষ্ট করতে চাইলেন! কিন্তু, সে তো অসম্ভব। অবধারিত শোচনীয়রকমভাবে পরাজিত হলেন। বাধ্য হলেন নতিস্বীকার করতে। তখন ব্রহ্ম থেকে উদ্ভূত হয়ে আবির্ভূত হলেন হৈমবতী দেবী উমা, 'জগদ্ধাত্রী'। তিনিই দেবতাদের দান করলেন পূর্ণব্রহ্মের জ্ঞান। জ্ঞানদাত্রী এই দেবী হলেন দেবপূজ্যা। ক্রমে জ্ঞানদায়িনী মাতৃময়ী জগদ্ধাত্রী নরলোকেও হয়ে উঠলেন পরমপূজনীয়া।
বাংলায় ঠিক কবে দেবী জগদ্ধাত্রীর পুজো শুরু হল, তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। তবে, এটুকু জানা যায় যে, কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকালের আগে অর্থাৎ আঠেরো শতকের সূচনায় জগদ্ধাত্রী স্বল্প পরিসরে অনাড়ম্বরে পুজো পেতেন। পরবর্তী সময়ে কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকালে তাঁর উৎসাহ, আগ্রহ ও পৃষ্ঠপোষকতায় শাক্তধর্মের পুনরুজ্জীবনের সাথে সাথে দুর্গা পুজো ও কালী পুজোর প্রসার যেমন ঘটেছিল, তেমনি ঘটেছিল দেবী জগদ্ধাত্রীর পুজোর প্রসারও। সেই ট্র্যাডিশনই আজ সমানে চলছে...