বাংলার নানা প্রান্তে একাধিক রূপে পূজিতা দেবী বিশালাক্ষী

"সন্ধ্যার সময় নদীর ঘাটে নামিয়া আসিতে পথের ধারে দেখিলেন একটি সুন্দরী ষোড়শী মেয়ে দাড়াইয়া। স্থানটি লোকালয় হইতে দূরে, সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছিল, পথে কেহ কোথাও নাই, এ সময় নিরালা বনের ধারে একটি অল্পবয়সী সুন্দরী মেয়েকে দেখিয়া স্বরূপ চক্ৰবৰ্ত্তী দস্তুরমত বিস্মিত হইলেন। কিন্তু তিনি কোনো কথা কহিবার পূর্বেই মেয়েটি ঈষৎ গৰ্ব্বমিশ্রিত অথচ মিষ্টসুরে বলিল-আমি এ গ্রামের বিশালাক্ষী দেবী।" 'পথের পাঁচালী' উপন্যাসে আমরা এইভাবেই পরিচয় পেয়েছি দেবী বিশালাক্ষী দেবীর। তবে ইতিহাস ঘাঁটলে বোঝা যায় যে- বাংলার কৃষিজীবী, জলজীবী ও বনজীবী লোকসমাজ তথা সুন্দরবন এলাকাতে বিশালাক্ষী দেবীর অনেক মহিমা রয়েছে। বিশেষত, কৃষক, জেলে, মৌয়ালি-বাওয়ালি পেশার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা এই দেবীর আরাধনা করেন। কথায় বলে, সুন্দরবনের জঙ্গলমহল যতদূর ছড়িয়ে রয়েছে, এই বিশালাক্ষী দেবীর পুজোর ক্ষেত্রে ততদূর ছড়িয়ে রয়েছে।

তবে এখানেই বিশালাক্ষী দেবীর মহিমা শেষ হয়ে যায় না। আবার ক্ষেত্র বিশেষে তিনি বিভিন্ন রকম ভাবে পূজিত। 

নানুরে চণ্ডীদাস সৃষ্ট বিশালাক্ষী মন্দিরে গত তিনশো বছর ধরে মহাসমারোহে দুর্গাপূজা হয়ে আসছে। এলাকায় ৩০টির বেশি সর্বজনীন ও পারিবারিক পুজো হলেও ভট্টাচার্য পরিবারের বিশালাক্ষী মন্দিরের পুজো মান্যতা পেয়ে আসছে প্রথম থেকেই। সপ্তমীর সকালে শুয়োর বলি করে এই পুজোর সূচনা হয়, মহাষ্টমীতে সন্ধিপুজোর বলিদান হয় জলঘড়ি দেখে‌। বিশেষ এই কারণগুলির জন্য এই পুজো নানুরের অন্যতম আকর্ষণে পরিণত হয়েছে।

কথিত আছে, ছশো বছর আগে কবি চণ্ডীদাস বাসুলি মায়ের পূজা করতেন এই নানুরে। পরবর্তীতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ধূলিস্যাৎ হয়ে যায় মন্দির সংলগ্ন এলাকা। পরিণত হয় উঁচু ঢিপিতে। তিনশো বছর আগে নানুর সংলগ্ন শাকুলিপুর গ্রামের তেলি সম্প্রদায়ের এক গৃহবধূকে দেবী বাসুলি স্বপ্নাদেশ দিয়ে নিজের অবস্থানের কথা জানান। একথা তাঁর পরিবার ও স্থানীয়দের জানানোর পরপরই মৃত্যু হয় ওই গৃহবধূর। এরপর ওই গৃহবধূর কথা মতো উঁচু ঢিপি খনন করে বাসুলি দেবীর মূর্তি উদ্ধার করা হয়। মহালয়ার আগে নবমী তিথিতে বাসুলি দেবী প্রথম পূজিত হন বলে তখন থেকে নবমীর দিনই বোধন হয়ে আসছে এই পুজোর। পরবর্তীকালে বিশালাক্ষী মন্দির সহ মোট ১৪টি শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই মন্দির প্রাঙ্গণে মোট ১৫টি শিবলিঙ্গ রয়েছে। সারাবছর বিশালাক্ষী ও শিবমন্দিরে নিত্যপূজা হলেও দুর্গাপুজো করা হয় মহাসমারোহে। 

স্থানীয় এলাকায় শাসন পুজো হিসেবে প্রচলিত এই পুজো। সপ্তমীর সকালে কলাবউ ও দোলা নিয়ে উত্তর দিক থেকে অন্যান্য পুজো কমিটি সমবেত হয় বিশালাক্ষী মন্দিরে। এরপর নানুরের দক্ষিণ দিকের একটি পুকুরে শোভাযাত্রা সহকারে ঘট ভরতে যাওয়া হয়। ফেরার পথে শুয়োর বলিদান করা হয়। কথিত আছে বর্গিদের অত্যাচার ঠেকাতে বাসুলি দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই বলিদান শুরু হয়। সেই প্রথা এখনও সমানে চলছে।

আবার বাঁকুড়ার ছাতনা অঞ্চলে চণ্ডীদাস পূজিত বাসুলিআছেন, তাঁর মূর্তি তুলনায় তন্ত্রসার গ্রন্থের ধ্যানমন্ত্রের নিকটবর্তী, যদিও মায়ের পূজা এখানে ধর্মপূজা বিধান অনুসারে ঘটে। বস্তুত ছাতনা অঞ্চলে মায়ের যে মূর্তি পাই, এই রূপেই মা বাসুলিরাঢ়ভূমিতে অধিকতর জনপ্রিয়ভাবে অধিষ্ঠিত। মা এখানে দ্বিভুজা। ডান হাতে খড়্গ এবং বাঁ হাতে খর্পর ধারণ করেন। মায়ের মুখে প্রশান্ত হাসি, মা মুণ্ডমালিনী। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হল, মা এখানে দুই পায়ে দুটি পুরুষমূর্তিকে দলন করেন, মায়ের একটি পা একদিকের শায়িত পুরুষমূর্তির জঙ্ঘায় অপর পা অপর পুরুষমূর্তির মস্তকে স্থাপিত, যে দুটি পুরুষমূর্তি এখানে অসুর বলে বর্ণিত।

আবার যদি হুগলিতে যাওয়া যায় দেখা যাবে পুরুষোত্তমপুরের যে সড়কটি গিয়ে জাতীয় সড়কের সঙ্গে মিশেছে বিশালাক্ষী মন্দির সেই রাস্তার পাশেই। একেবারেই ভাঙাচোরা মন্দির। চূড়োয় গাছের জঙ্গল গজিয়েছে। ধসে পড়েছে মন্দিরের বাঁদিকটা। এখন শুধু চোখ টানে টেরাকোটার অবশিষ্ট অলংকরণগুলো। রামায়ণের নানা কাহিনি প্যানেল জুড়ে। আরও প্যানেল ছিল। সে সব ভেঙে পড়েছে। সে জায়গায় বালি-সিমেন্টের প্রলেপ। মন্দিরের প্রতিষ্ঠা প্যানেলটি এখনও রয়েছে। তাতে লেখা ১১৩৮ বঙ্গাব্দ। ২৯১ বছরের পুরনো মন্দির। ওই প্যানেলে আরও কতকগুলো সংখ্যা রয়েছে। এগুলো হল, ১৬৬২। এটি সম্ভবত শকাব্দ। সংখ্যাগুলো খ্রিস্টাব্দে রূপান্তরিত করলে দাঁড়ায় ১৭৪০। সেখানেও বিশালাক্ষী দেবী প্রথা মেনে পূজিত হন।

অন্যদিকে প্রাচীন কৃষ্ণবল্লভপুর অথবা দেবীর আশীর্বাদে প্রাপ্ত নাম বলদবাঁধ গাঁয়ে দেবী বিশালাক্ষী প্রকৃতই বিশাল। তিনি আমাদের মত সাধারণের চোখে হয়ত ভয়াল, রুদ্র দর্শনা কিন্তু তিনিই সাধারণ গ্রামবাসীকে রক্ষা করেন। ৮ ফুট উচ্চ দেবীমূর্তি চতুর্ভুজা। তাঁর বাম হস্তদ্বয় সশস্ত্র, দক্ষিণ হস্তদ্বয় বরাভয় মুদ্রা। মন্দিরের দৈর্ঘ্য ২৭ ফুট ১০ ইঞ্চি। প্রস্থ ৩১ ফুট। গর্ভ গৃহে প্রবেশের মুখটি খিলানাকৃতির। সেই খিলানের ব্যাস ৩ ফুট ৮ ইঞ্চি। মন্দিরটি দক্ষিণমুখী। মন্দিরচত্বর ১৮ কাঠা জমির উপরে অবস্থিত। মা বিশালাক্ষীর মন্দিরটির উত্তর দিক দিয়ে বয়ে গেছে কানা নদী। গর্ভগৃহের অভ্যন্তরে ৫ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১ ফুট ৬ ইঞ্চির প্রস্থের একটি বাঁধানো বেদীর উপরে দেবীর অবস্থান। দেবীর গাত্র বর্ণ কাঁচা হলুদ, পরনে নীল পাড় লাল শাড়ি। যদিও পূজা পার্বন ও ভক্ত গনের দেওয়া কাপড় পরিবর্তন করা হয়। পদতলে শুয়ে শ্বেতবর্ণ কৃত্তিবাস মহাদেবস্বরূপ মহাকাল। তাঁর অর্ধনিমিত চক্ষু, মাথায় জটা। ডান হস্ত মাথার তলায় দিয়ে কাত হয়ে শুয়ে আছেন।বাম পা সামনের দিকে, ডান পা টি পিছনের দিকে। ত্রিনয়ন মহাকালের কণ্ঠদেশে রুদ্রাক্ষের মালা, হস্তে রুদ্রাক্ষের বলা, কর্ণে ধুতুরা ফুল। অহিভূষণ মহাকালের বাম হাতে ডমরু ও কলকে। হাতটি কিঞ্চিৎ ঊর্ধ্বমুখী। সেই হাতের কনুইয়ের ভাঁজে হরিদ্রাভ মুন্ড। মুন্ডের কাটা গলা হতে রক্ত ঝরছে। মুন্ডের বিশাল চক্ষু, পুষ্ট গোঁফ, কপালে রক্ত তিলক। মহাকালের পিছনে আরেকটি হরিৎ বর্ণের নরমুন্ড। তার ঘনসবুজ মুখ বর্ণ, তার মাথায় বাবরি চুল, পাকানো গোঁফ, বিস্ফারিত দৃষ্টি। দেবী বিশালক্ষীর দেহাবয়ব পুরুষালী । তিনি মুক্তকেশী ও আয়তলোচনায় বিশাললোচনী তাই তাঁর নাম বিশালাক্ষী। তাঁর গলদেশে তেরোটি মুন্ডের মালা। মুখমন্ডল দীর্ঘ এবং লম্বাটে। কর্ণ যুগল মুখমন্ডলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বৃহৎ। তবে বৃহৎ মুখমন্ডলের তুলনায় দেহের নিম্ন ভাগ অপেক্ষাকৃত ছোট বা খাটো দেবীর মুখমন্ডলের গঠন খানিকটা বর্ধমানের নতুনগ্রামের তৈরি কাঠের পুতুলের মত। এক বারেই পেলবতাহীন ও সামগ্রিকভাবে নারী সুলভ নয়। অর্থাৎ , তাঁর এই রূপ যুদ্ধের রূপ। তিনি মহাপরাক্রান্ত , রুদ্র তেজে দীপ্তঃমান। তিনি তাঁর বিশাল অক্ষি দ্বারা মহামায়া রূপে কাল ও জগৎকে অবলোকন করেন। তিনি তাঁর তেজে সকল পাপ ও অশুভকে নাশ করেন। দেবীর গলায় হার, মাথায় মুকুট, কানে দুল, হাতে চুড়ি, বাহুতে অঙ্গদ , পায়ে নুপুর আছে। দেবীর সিঁথিতে সিঁদুর চর্চিত। দেবীর হাতের তালুতল ও পদযুগল রক্তিম। দেবীমুর্তির সম্মুখভাগে একটি দুই ধাপের বেদী। বেদীর দৈর্ঘ্য এক ফুট ছয় ইঞ্চি। প্রস্থ এক ফুট। এটিই সেই জনৈক্য তান্ত্রিক প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন পঞ্চমুন্ডির আসন। বর্তমানে বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রতীকস্বরূপ বেদীর উপর নির্মিত পাঁচটি ছিন্নমূন্ড নির্মাণ করে রাখা আছে। 

পৌরাণিক তথ্য অনুসারে সত্য যুগের কোনও এক সময়ে মহাদেবের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দক্ষরাজ এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। দক্ষরাজের কন্যা সতী দেবী তাঁরই ইচ্ছার বিরুদ্ধে 'যোগী' মহাদেবকে বিবাহ করায় দক্ষরাজ নিজের কন্যার প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন। দক্ষরাজ মহাদেব ও সতী দেবীকে ছাড়া তাঁর অনুষ্ঠিত মহাযজ্ঞে প্রায় সকল দেব-দেবীকেই নিমন্ত্রণ করেছিলেন। মহাদেবের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সতী দেবী মহাদেবের অনুসারীদের সঙ্গে নিয়ে সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন। কিন্তু সতী দেবী আমন্ত্রিত অতিথি না হওয়ায় তাঁকে চরম অপমানিত করেন দক্ষরাজ। শুধু এই নয় সতী দেবীকে সামনে রেখে দক্ষরাজ মহাদেবের নিন্দা করেন ভরা সভায়। সতী দেবী তাঁর স্বামীর প্রতি পিতার এহেন অপমান সহ্য করতে না পেরে যোগবলে আত্মাহুতি দেন। শোকাহত মহাদেব রাগান্বিত হয়ে দক্ষরাজের যজ্ঞ নষ্ট করেন এবং সতী দেবীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে বিশ্বব্যাপী তান্ডব নৃত্য শুরু করেন। এই তান্ডব নৃত্যের কারণে ধ্বংসলীলা শুরু হয় সমগ্র বিশ্বে। প্রলয় থামাতে ভগবান বিষ্ণু দেবী সতী মায়ের দেহ সুদর্শন চক্রের সাহায্যে খন্ডিত করেন। সেই দেহখন্ড ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে পড়ে, এবং স্থানগুলো পরবর্তীতে পবিত্র পীঠস্থান তথা শক্তিপীঠ হিসেবে পরিচিত হয়। উত্তরপ্রদেশের বারাণসী বা বেনারসের এই স্থানে দেবী সতীমায়ের কানের দুল বা চোখ পড়েছিল। তাই এই পীঠস্থান নাম বিশালাক্ষী সতীপীঠ। যদিও কেও কেউ এখানে দেবীর নাম শুনে মনে করেন- বিশাল অক্ষী অর্থাৎ দেবীর দিব্যনেত্র পড়েছিল বলেই এরূপ নামকরণ হয়েছে। কেও কেও একে মনিকর্নিকার মন্দির রূপেও চিনে। তবে বিশালাক্ষী দেবী যে রূপেই পূজিত হন, তিনি মহিমাময়, বাংলায় প্রায় সর্বত্রই বিশেষ ভাবে বন্দিত হয়ে থাকেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...