সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার মন্দির

এই পৃথিবী তাঁর ইচ্ছায় সৃষ্টি। তিনিই সৃষ্টা। হিন্দু শাস্ত্র মতে মনে করা হয়, জগতের সৃষ্টি কর্তা হলেন প্রজাপতি ব্রহ্মা। তিনিই এই ব্রহ্মান্ড সৃষ্টি করেছেন। তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ীই আমাদের জীবন চলে। তিনিই বিধাতা। তিনিই সব কিছু। পূরাণ মতে, হিন্দুদের ৩৩ কোটি দেবতা রয়েছেন। তাঁরা স্বমহিমায় নিজ নিজ ক্ষমতায় বিখ্যাত। সারা পৃথিবীতে যেখানে যত হিন্দু রয়েছে, সেখানেই গড়ে উঠেছে হিন্দু দেবতাদের মন্দির। সারা পৃথিবী জুড়ে প্রত্যেক হিন্দু দেবতার অজস্র মন্দির রয়েছে। কিন্তু আমাদের সৃষ্টিকর্তা, যিনি আমাদের বিধাতা, অর্থাৎ প্রজাতি ব্রহ্মা; গোটা দেশে সেই ব্রহ্মার মন্দির রয়েছে মোটে একটি। দেশের একমাত্র ব্রহ্মা মন্দিরটি রয়েছে রাজস্থানের পুষ্করে। তবে আরও একটি মন্দির রয়েছে, যা খাতায়-কলমে ব্রহ্মা মন্দির না হলেও এখানে অনেক ভক্তই প্রজাপতি ব্রহ্মার উপাসনায় ব্রতী হন। ধর্মপ্রাণ ভক্তেরা ভিড় করেন এখানে। তামিলনাড়ুর তিরুচিরাপল্লি থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে তিরুপাট্ট‌ুরের শ্রী ব্রহ্মাপুরেশ্বরার মন্দিরটিতে ব্রহ্মার পুজো করা হয়। স্থানীয়দের বিশ্বাস, এই মন্দিরে পুজো দিলে ভাগ্য ফেরে।

জগতের ঈশ্বর হলেন ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর। দেবাদীদেব মহাদেবকে সর্বশ্রেষ্ঠ ঈশ্বর বলে মনে করা হলেও পূরাণ অনুযায়ী, আমাদের সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মাই। যেখানে সারা দেশে মহাদেবের ভক্ত এবং তাঁর জন্য স্থাপিত মন্দিরের সংখ্যাও অগণিত। অন্যান্য দেবতাদের সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু সেখানে সৃষ্টি কর্তা ব্রহ্মার ভক্তের সংখ্যাটা ঠিক কত জানা নেই। কিন্তু তাঁর জন্য স্থাপিত মন্দিরের সংখ্যাটা মাত্র একটি। অবাক মনে হলেও এটাই বাস্তব। সারা দেশে প্রজাপতি ব্রহ্মার একটি মাত্র মন্দির রয়েছে। এই মন্দিরটি রাজস্থানের পুষ্করে অবস্থিত।

যদিও এই মন্দিরটি মহাদেবের নামে উত্‍সর্গীকৃত, কিন্তু অনেকেই এখানে ব্রহ্মার আরাধনা করেন। প্রচলিত বিশ্বাস মতে মনে করা হয়, এই মন্দিরে খোদ ব্রহ্মা এসে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করেছিলেন। তাই অনেকই মনে করেন এই মন্দিরে পুজো দিলে ভাগ্য পরিবর্তন করা সম্ভব।

কিংবদন্তী অনুযায়ী, পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা একসময় নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে ভাবতে শুরু করেন। অহঙ্কারে মত্ত হয়ে তিনি মহাদেবকে হেয় করতে শুরু করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে মহাদেব ব্রহ্মার পঞ্চম মস্তক গুঁড়িয়ে দেন এবং তাঁকে অভিশাপ দেন যে ব্রহ্মা তাঁর সৃষ্টিক্ষমতা হারিয়ে ফেলবেন। এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে ব্রহ্মা সাধারণ তীর্থযাত্রী সেজে শিবের মন্দিরে মন্দিরে পুজো দিয়ে বেড়াতে শুরু করেন। এই মন্দিরে ব্রহ্মা নিজে ১২টি শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর উপাসনায় খুশি হয়ে মহাদেব ব্রহ্মাকে দেওয়া অভিশাপ ফিরিয়ে নেন। মহাদেব আরও বলেন যে এই মন্দিরে যাঁরাই পুজো করবেন, তাঁরা নিজেদের ভাগ্য নতুন করে লিখতে পারবেন।

FotoJet - 2022-07-23T124936.907

মন্দির প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে রয়েছে এক কাহিনী। পুরান মতে, একদিন সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা ও পালনকর্তা বিষ্ণু দেবাদীদেব মহাদেবের আদি ও অন্ত খুঁজতে বের হলেন। ব্রহ্মা দেবাদীদেব শিবের আদি অর্থাৎ মস্তকের চূড়া উপরের দিক খুঁজতে বের হলেন আকাশের দিকে। বিষ্ণু দেবাদীদেব শিবের অন্ত পাতালের দিকে খুঁজতে বের হলেন। ব্রহ্মা তখন একটি রাজহাঁসের রূপ ধারন করে আকাশের দিকে উড়তে লাগলেন। অন্যদিকে বিষ্ণু একটি বরাহের রূপ ধারন করে পৃথিবীর আরও গভীরে যেতে লাগলেন। এমন করে হাজার হাজার বছর খুঁজে চললেন তারা। তবু তারা দেবাদীদেবের আদি ও অন্ত খুঁজে পেলেন না। তারা ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। বিষ্ণু ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। অন্যদিকে ব্রহ্মা একটি কেতকী ফুল বাতাসে ভেসে ভেসে নীচের দিকে পড়ছে দেখতে পেলেন। তিনি ফুলটিকে থামালেন ও সে কোথা হতে আসছে তা জিজ্ঞেস করলেন। জবাবে কেতকী ফুল বলল যে সে শিবের মস্তকে ভক্তের দেওয়া ফুল। সে সেখান হতে পড়ছে। তখন ব্রহ্মা আর না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি কেতকী ফুলকে শিখরে পৌঁছার প্রমান হিসেবে ব্যাবহারের সিদ্ধান্ত নিলেন।

এরপর ব্রহ্মা ও বিষ্ণু পৃথিবীতে ফিরে এলেন। সাত্ত্বিক বিষ্ণু সত্যি কথা বললেন। কিন্তু রাজসিক ব্রহ্মা ছলনার আশ্রয় নিলেন। মহেশ্বর শিব তার ছলনা ধরে ফেললেন। তখন ব্রহ্মাকে মহেশ্বর শিব কোন মন্দির হবে না বলে অভিশাপ দিলেন। আর কেতকী ফুলকে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার জন্যে শিব, নিজ পুজায় তার ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন।

পুষ্করকে বলা হয় মন্দিরের শহর। এই স্থানের হিন্দু মন্দিরগুলি মোঘল শাসকের ধ্বংস করেছিল। কিন্তু ব্রহ্মা মন্দির আজও একই ভাবে রয়ে গিয়েছে। কথিত রয়েছে, পুষ্কর হ্রদ ব্রহ্মার একক পদ্ম পাতা দিয়ে তৈরি। এই কারণে হিন্দুদের কাছে এই হ্রদ পবিত্র। মন্দিরের মেঝেতে রৌপ্য কচ্ছপ খোদাই করা রয়েছে। মন্দিরের গর্ভগৃহে বিরাজ করছেন ব্রহ্মা। তাঁর মূর্তি চারমুখী। এই মন্দিরে ব্রহ্মার সঙ্গেই বিরাজ করেন প্রজাপতি ব্রহ্মার সঙ্গী স্ত্রী গায়ত্রী।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...