প্রাচীন দেবস্থানসমৃদ্ধ অসংখ্য জনপদের অবস্থান দক্ষিণ বাঁকুড়ায় শিলাবতী নদীর কূলে কূলে। খাতড়া ও সিমলাপালের প্রায় মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত, এই নদীর উত্তর কূলের তেমনই একটি প্রাচীন গ্রাম, ‘গাঁড়রা’। এই গ্রামে রয়েছে বহু প্রাচীন একটি প্রস্তর নির্মিত শিবলিঙ্গ। শিবের নাম, ‘শান্তিনাথ’।
শিবলিঙ্গটি কে এবং কবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তার কোন ইতিহাস নেই। সকলের বিশ্বাস, ‘শান্তিনাথ’ স্বয়ম্ভু শিব। মাটি থেকে তিনি উদ্ভূত হয়েছেন নিজেই। বিভিন্ন স্বয়ম্ভু শিবলিঙ্গের ক্ষেত্রে যে-কাহিনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শুনতে পাওয়া যায়, তারই একটি ভাষ্য এখানেও শোনা যায়ঃ
বহু প্রাচীন কালে এখানে একটি কলু বাস করত। তার একটি বেশ ভালো দুগ্ধবতী গাভী ছিল। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে কলু লক্ষ করছিল যে, গাভিটি দুধ দোয়ানোর সময় ভীষণ ছটফট করে, আর দুধও বেশ কম দেয়। কলু বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ল। কিন্তু কী থেকে যে কী হচ্ছে, কলু তার কিছুই বুঝতে পারল না।তখন তো আর জনবসতি বেশি ছিল না। তার মাটির বাড়ির চাদ্দিকেই পোড়ো জমি। আর তাতে ঝোপঝাড় আর গাছগাছালিতে ভরা। তাই কলু বাড়ির আশেপাশেই ঘানির বলদগুলোর সঙ্গে গাইটিকে চরাত।একদিন চরাতে চরাতে সে হঠাৎ খেয়াল করল যে, গাইটি একটি ঝোপের মধ্যে ঢুকছে, কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থাকছে—তারপরই আবার বেরিয়ে আসছে। একদিন, দু’দিন, তিনদিন—নির্দিষ্ট ঝোপটিতে এমনি করে একই ঘটনা পর পর কয়েকটা দিন ঘটতে দেখল সে।তারপরই তার টনক নড়ল, নিশ্চয়ই ঝোপটির মধ্যে কিছু একটা রহস্য আছে, গিয়ে দেখতে হবে তো গাইটা ঝোপে ঢুকে করেটা কী!
পরদিন চরতে গিয়ে যেই গাইটা নির্দিষ্ট ঝোপে ঢুকেছে, অমনি তার পিছু পিছু কলু সেই ঝোপটার কাছে গিয়ে উঁকি মেরে দেখতে লাগল গাইটার কাণ্ডকারখানা! এবং সে দেখে অবাক হয়ে গেল যে, ঝোপের মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়ানোর পরই গাইটার পালান থেকে অঝোর ধারায় ঝরে পড়ছে অঢেল দুধের ধারা! ব্যাপারটা দেখেই তার চোখ কপালে উঠল। যে গাই এমনিতে দুধ দেয় না, তার কিনা বিনে দোয়ানিতেই দুধ ঝরছে!—এ কথা ভাবতে ভাবতেই সে আবার অবাক হয়ে দেখল যে, দুধের ধারা আপনা আপনি বন্ধ হয়ে গেল। এবং, অমনি গাইটাও ঝোপ থেকে বেরিয়ে আবার আগের মতোই চরতে শুরু করে দিল।
কলু এবার পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল যেখানে গাইটার দুধ ঝরে পড়েছে, সেখানে। গিয়ে দেখল শুকনো পাতা পচে গিয়ে মাটি দেখা যাচ্ছে এবং সেই মাটি দুধে ভিজে আছে। আর কিচ্ছু নেই। কলু এবার ভাবল যে, রহস্য তাহলে মাটির ওপরে নেই, নীচে আছে। আর সেই রহস্য এক্ষুনি ভেদ করতে হবে।
ব্যস, বাড়ি থেকে একখানা কোদাল এনে ধাঁই ধপাধপ এলোপাথাড়ি কোপ মারতে শুরু করল সে। কয়েক কোপ মারতেই বিকট ঠকা-ঠাঁই শব্দ উঠল! আর অমনি তার মুখ থেকে ভলকে ভলকে রক্ত বেরুতে শুরু করল। তারপরই প্রচণ্ড চিৎকার করে ছটফট করতে করতে সে মারা গেল।চিৎকার শুনে ছুটে এল কলুর বউ। সে এসে এই বিপত্তি দেখে কাঁদতে কাঁদতে ছোটাছুটি করে প্রতিবেশীদের ডাকতে লাগল।প্রতিবেশীরা এসে দেখল যে, কলু মারা গেছে। কোদাল ও মাটি সরিয়ে দেখল, সেখানে বেরিয়ে এসেছে পাথরের শিবলিঙ্গের অগ্রভাগ। সেই অগ্রভাগ থেকে কোদালের এক কোপে কেটে বেরিয়ে এসেছে পাথরের টুকরো!তখন তারা বুঝল যে, আঘাত করার অপরাধে মহাদেবের কোপেই কলুর মৃত্যু হয়েছে। এও বুঝল যে, এই মহাদেব অত্যন্ত জাগ্রত।এরপরই তারা মাটি সরিয়ে মহাদেবকে বের করে আনল এবং পুজো করতে শুরু করল। কালক্রমে ধীরে ধীরে দিকে দিকে মহাদেবের মহিমার কথা ছড়িয়ে পড়ল। ভক্ত সমাগমও বাড়তে শুরু করল।
আবির্ভাবের কথা জানা গেলেও এই শিবের ‘শান্তিনাথ’ নাম কীভাবে হল, কিংবদন্তিতে তার কোন উল্লেখ নেই। কখন থেকে তিনি এই নামে অভিহিত হতে শুরু করলেন তার কোন ইতিহাসও নেই।কিংবদন্তির সত্যতা যাচাই করার কোন উপায় নেই। তবে কলুর কোদালের কোপে শিবলিঙ্গের অগ্রভাগ কেটে যাওয়ার যে মিথ, সেই কেটে যাওয়ার চিহ্ন আজও দেখা যায়। মন্দিরের দরজা দিয়ে ঢুকে দাঁড়ালে লিঙ্গমূর্তির মাথায় ডান দিকে এই চিহ্ন অনায়াসেই দেখা যায়।লিঙ্গমূর্তিটি সতীপীঠ সমন্বিত। সতীপীঠ প্রায় আড়াই ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট, তার ওপরে লিঙ্গমূর্তিটি আবার দেড় ফুট উঁচু। সব মিলিয়ে প্রায় চার ফুট উচ্চতা সতীপীঠসহ লিঙ্গমূর্তির। লিঙ্গমূর্তির মাথায় কড়েআঙুল-পরিধির গোল একটি ছিদ্র রয়েছে। লিঙ্গ ও সতীপীঠের মধ্যে সামান্য ফাঁকও রয়েছে।
আদিতে শিবের কোন মন্দির ছিল না। উন্মুক্তস্থানেই শিব পূজিত হতেন। শোনা যায় যে, আজ থেকে প্রায় সত্তর-আশি বছর আগে এক শৈব সন্ন্যাসী এসে এখানে ঘাঁটি গাড়েন। এবং, ভিক্ষের মাধ্যমে টাকা-পয়সা সংগ্রহ করে মাকড়া পাথরের ভিত্তি ও কিছুটা দেওয়াল তোলেন। তারপর তিনি হঠাৎ করেই একদিন তাঁর এই কর্মকাণ্ড ছেড়ে চলে যান।অবশ্য পরে সেই ভিত্তির ওপর ইটের দেওয়াল তুলে মন্দির সম্পূর্ণ করা হয়। মন্দিরের আলাদা কোন বৈশিষ্ট্য নেই। বেশ উঁচু ভিত্তির ওপর একতলা বাড়ি যেমন হয়, তেমনি।
শান্তিনাথ শিবের নিত্য পুজো, প্রতি সোমবারের পুজো তো হয়ই; তাছাড়াও চৈত্র মাসে বেশ সমারোহের সঙ্গে এখানে শিবের গাজন অনুষ্ঠিত হয়।শান্তিনাথের পুজোর দায়িত্বে আছেন গাঁড়রা গ্রামের চক্রবর্তীরা। এঁদের পূর্বপুরুষকে পূজারী করে মন্দির-সংলগ্ন ভূমিতে এনে বসিয়েছিলেন ভেলাইডিহার রাজা। অন্নসংস্থানের জন্য কিছু জমিও দান করেছিলেন।সতের শতকে ভেলাইডিহা রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন লস্কর সিংহচৌধুরী। সকলে ‘রাজা’ বললেও তিনি ছিলেন আসলে ছ’আনির জমিদার। তাঁর পরগণা ছিল ‘ভেলাইডিহা’। ভেলাইডিহা, শিলাবতীর অপর পারের একটি গ্রাম। লস্করের সময় থেকেই শান্তিনাথের গাজনে তাঁর তরফ থেকে ‘ভক্ত্যা’ দেওয়ার প্রথা শুরু হয়। উত্তরসূরিদের মধ্যেও সেই ধারা বেয়ে প্রথাটি এগিয়ে চলেছে আজও।অবশ্য এখন রাজার তরফে তথাকথিত অন্ত্যজ শ্রেণির ন’জন মানুষকে ভক্ত্যা হিসেবে নিয়োগ করা হয়। ব্রতের এ-কদিন তাঁদের থাকা-খাওয়ার সমস্ত দায়িত্ব ঐ রাজপরিবারের।
গাজনের সময় যারা ‘সন্ন্যাস ব্রত’ নেন, তাঁদের বলা হয় ‘ভক্ত্যা’। গাজনের ডঙ্কা বাজে ২৮শে চৈত্র থেকে। এদিন ধুতি পরে খালি গায়ে গামছা সম্বল করে বেতের লাঠি হাতে ভক্ত্যা হতে ইচ্ছুক ভক্তেরা একে একে জড়ো হন মন্দির প্রাঙ্গণে।মন্দিরের সামনে উপস্থিত নাপিত তাঁদের নখ কেটে (আগে চুল-দাড়িও কাটত) শুদ্ধ করে দেয়। তারপর ভক্তেরা স্নান করে এলে পুরোহিত নতুন পৈতে পরিয়ে দেন, কব্জিতে সাদা সুতোয় তৈরি তাগা বেঁধে দেন। ব্রাহ্মণ ছাড়াও অন্যশ্রেণির মানুষেরাও এদিন পৈতে পরেন। তবে তাঁরা পরেন গলায়, কণ্ঠমালার মতো করে।
ভক্ত্যা হলে পরেই শুরু হয়ে যায় কৃচ্ছ্রসাধনা। ভক্ত্যা সারাদিন জল ও শরবৎ পান করে একাহারী হয়ে থাকেন। রাত্রে শুধু হবিষ্যি করেন। এক কাপড়ে থাকেন। সকাল-বিকাল দু’বার স্নান করে মন্দিরে গিয়ে শিবের পুজো করেন। মাটিতে শুধুমাত্র চাটাই পেতে শয়ন করেন। ২৮শে’র বিকেলে শুরু হয়ে এই নিত্যকর্ম চলে ৩০শে’র বিকেল পর্যন্ত।৩০শে’র বিকেলে শিলাবতীতে স্নান করে শান্তিনাথের নামে জয়ধ্বনি দিয়ে বেতে বেতে ডান্ডিয়া খেলার ঢঙে লাঠি খেলতে খেলতে মন্দিরে এসে মহাদেব পুজোর মধ্য দিয়ে ব্রতের সমাপ্তি হয়। একবার ভক্ত্যা হলে, পর পর তিন বছর ভক্ত্যা হতে হয়। এমনটাই নিয়ম।
ভক্ত্যা হয়েও ‘মানসিক’ বা ‘মানত’ পূরণের জন্য পাঁচ রকমের আলাদা আলাদা কৃচ্ছ্রসাধনা আছে। যথা, ‘প্রণাম সেবা’, ‘লোটন সেবা’, ‘আগুন সেবা’, ‘ছেল্যাকাঁদা’, ‘পাটভক্ত্যা’।
শিলাবতীতে স্নান করে জল থেকে মন্দির অব্দি প্রায় এক কিলোমিটার পথ শান্তিনাথের উদ্দেশ্যে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে দণ্ডি দিতে দিতে মন্দির অব্দি আসাকে বলে, ‘প্রণাম সেবা’।
শীলাবতীর জল থেকে মাটিতে গড়াতে গড়াতে একবারও না-উঠে মন্দির অব্দি আসাকে বলে, ‘লোটন সেবা’।
শীলাবতী জলে স্নান করে সেখান থেকে মাথায় কাদার বেদিতে মাটির খোলা বসিয়ে তাতে আগুন জ্বেলে তা মন্দির অব্দি বয়ে নিয়ে আসাকে বলে, ‘আগুন সেবা’।
চিতার পোড়া হাড় ও কাঠকয়লায় আগুন জ্বেলে তা ভাঁড়ের মধ্যে ভরে আমপাতায় মুখ বন্ধ করে পেটের ওপর চেপে মন্দিরে আসা, ‘ছেল্যাকাঁদা’।
আর, পেরেক পোঁতা মানুষ আকৃতির তক্তার ওপর শুয়ে নদী থেকে মন্দির অব্দি আসাকে বলে,‘পাটভক্ত্যা’।
বাঁকুড়ার বীভৎস গরম, প্রখর তাপ ও গুমোট আবহাওয়ায় এই সমস্ত কৃচ্ছ্রসাধনার একটিও পালন করা একেবারেই সহজ নয়। শুধুমাত্র ভক্তিজনিত মানসিক দৃঢ়তায় ভক্ত্যারা এসব পালন করেন।
গাঁড়রার কাছাকাছি বা দূরবর্তী বহু গ্রামের মানুষ গাজনে ভক্ত্যা হন। তাঁদের সংখ্যা প্রায় শ’পাঁচেক। মন্দিরে গাজনের দু’দিন অসংখ্য নারীপুরুষ ভক্তের ঢল নামে, পুজো চলে ভোর থেকে সন্ধ্যে। ভক্ত্যাদের ক্রমাগত ‘কাশী বিশ্বেশ্বর লাটমণি পাটমণি গম্ভীরের ভোলানাথের চরণে সেবা লাগে’, ‘হর পার্বতী লাটমণি পাটমণি শান্তিনাথের চরণে সেবা লাগে’ ধ্বনিতে গ্রামের আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে।
শান্তিনাথের গাজন আদিতে হয়তো ছিল ধর্মের গাজন। এরকম মনে করার একটি কারণ আছে। মন্দিরের সামনে রাস্তার ওপর একটি কাছিমের পিঠের আকৃতির মাকড়া পাথর আদি থেকেই প্রতিষ্ঠিত ছিল। সারা বছর সেই পাথর পুজো হত না, গাজনের সময় শুধু পুজো হত। পুজো করতেন তথাকথিত অন্ত্যজ শ্রেণির ভক্ত্যারা।
অবশ্য এখন পাথরটিকে তুলে ‘সতী’ নাম দিয়ে মন্দিরের বাইরে বেদীতে বসিয়ে নিত্য পুজো করা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস, এই পাথরটি ছিলেন, ধর্ম ঠাকুর। এবং তাঁকে কেন্দ্র করেই এখানে গাজনের উদ্ভব ও প্রসার। কালক্রমে শিবের সঙ্গে মিলে গিয়ে এই গাজন শুধুমাত্র শিবেরই গাজন হয়ে উঠেছে।
পূর্বে গাজন উপলক্ষে মন্দিরের সামনে বিশাল মেলা বসত। প্লাস্টিকের খেলনা, বেলুন, শোলার খেলনা, তালপাতার পাখা, মিষ্টি জিলিপির দোকান, ঘুগনি, চাঁদমালা-বাতাসার দোকান, চপ-তেলেভাজার দোকান বসত। চাদ্দিক ভিড়ে ভিড়ে ছয়লাপ হয়ে যেত। চলত সাতদিন ধরে তাঁবুর সিনেমা, রাত্রে তিন দিন ধরে হত গ্রামীন মানুষের শখের যাত্রাপালা।
এখন সিনেমা আর হয় না। খোলা জায়গার অভাবে মেলার বহরও বেশ কমে গেছে। কিন্তু আত্মীয়-স্বজনের আগমনে, তাদের কলতানে গাঁড়রা এবং আশপাশের গ্রামগুলো আজও এই গাজন উপলক্ষে জমে ওঠে ভরে ওঠে। আগের মতোই বিপুল পূন্যারথীদের ভিড়ে আজও সরগরম হয়ে ওঠে এখানকার শান্তিনাথের গাজন।