বছর পঁয়ত্রিশ পূর্বে গরমের দুপুরটি যখন খাঁ খাঁ, ঘুম ঘুম কানে বেহায়া কাকের হাঁকডাক; তখন সেভেনের ক্লাসরুমে আমাদের সংস্কৃত স্যার কমলবাবু ‘হিতোপদেশ'-থেকে উপদেশের টুকরো টেনে টেনে আওড়াচ্ছিলেন—
"উৎসবে ব্যসনে চৈব দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্রবিপ্লবে।
রাজদ্বারে শ্মশানে চ যস্তিতিষ্ঠতি স বান্ধবঃ।।"
শ্লোক শেষে নাকের ওপর নেমে আসা চশমাটা এক খোঁচায় স্বস্থানে ফিরিয়ে দিলেন। তারপর টেকো কপালের নীচে মোটা ভুরু দুটিকে নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন—'মানে বলতে পারবি কেউ?'
আমাদের যেমন 'মানে' বলার গরজ ছিল না; তেমনি প্রশ্ন করে উত্তর জানার মতো ধৈর্য তাঁরও ছিল না। সেকেন্ড দু'য়েকের পেন্ডুলামবৃত্তিতে মাথাটা বাঁ-দিকের বেঞ্চ থেকে ডান-দিকের বেঞ্চ--বার দুই দুলিয়ে নিলেন। তারপর দাঁত চেপে ঠোঁটের কোনে একরাশ শ্লেষ ঝুলিয়ে বললেন—"গর্দভের দল (এটা তাঁর প্রিয় সম্বোধন)! জানতুম পারবি না! তোদের দেখলেই মনে হয়, ইস্কুলে আসি না, আসি তুষে পার দিতে! গর্ধভের দল শোন, শ্লোকটার মানে হচ্ছে--উৎসবে-ব্যসনে-রাজদ্বারে-দুর্ভিক্ষে-শত্রুভয়ে-শ্মশানে যে সবসময় পাশে থাকে, সেই হচ্ছে ‘বন্ধু’। বুঝেছিস?"
এই লাস্টের প্রশ্নটাই আমাদের হেব্বি প্রিয়। টুক করে মাথা নেড়ে 'হ্যাঁ' জানাতে আমাদের একটুও কিপ্টেমি নেই। কত বড় বড় অবুঝ অঙ্ক আমরা বলে এই করেই পার করে দিয়েছি, আর এ তো শুধু ‘বন্ধু’। এর আবার না-বোঝার কী আছে? রবিবারের বিকেল চারটেয় 'অনুষ্ঠান প্রচারে বিঘ্ন ঘটায় দুঃখিত' এবং 'ছায়াছবির পরবর্তী অংশ সংবাদের পর'-এর মতো জলজ্যান্ত দু'দুটো বাধা টপকে দূরদর্শনে ক’দিন আগেই তো দেখলাম, উত্তমকুমারের সিনেমা—‘হাত বাড়ালেই বন্ধু’। তা, হাত বাড়ালেই যখন বন্ধু হওয়া যায়, তখন রাজদ্বার-ফাজদ্বার-দুর্ভিক্ষের ভয় দেখিয়ে ছোটদের মাথা গুলিয়ে না-দিলেই কী নয়? আর, আমাদের যেন 'বন্ধু' নেই, আমরা যেন 'বন্ধু' পাতাইনি, আমরা যেন বুঝিনা 'বন্ধু' কী! কই, তার জন্য তো এতকিছু ঝামেলা পুইয়ে মরতে হয়নি!
শিলাবতী নামে আমাদের একটি তিরতিরে নদী ছিল। দুই ঠোঁটের ফাঁকে ফিনিক ফোটা হাসির মতন কলকল করে, পাড়া-মাতানো উচ্ছল কিশোরীটির মতো এক্কাদোক্কা পায়ে নুড়ি মাড়িয়ে বয়ে যেত সে। চাঁদের রাত আর রোদমাখা দিনের সাথে তার ছিল আদিম সখ্য, দেখা হলে চিকচিক করে উঠত তার গা-ভরা বালু, ঝিকমিক করে উঠত বুক-বাওয়া জল। তার এ-পারে ছিল আমাদের গাঁ, আর-পারে অন্য কারও। পরপারে দাঁড়িয়ে, এ-পারে তাকালে, ঠিক যেখানটায় একরাশ টগরের ঝাড় দেখা যেত, নদীর গা-ছুঁয়ে সেইখানে ছিল আমাদের প্রিয় পাঠশালা। সুযোগ বুঝে কতদিন কত ছুতোনাতায় পাঠশালে পাততাড়ি ফেলে পাড়াময় চরকি দিয়েছি, সেই তালে পণ্ডিতমশাই অব্দি চেয়ারের হাতলে দুই পা তুলে ঢুলতে শিখে গেলেন; কিন্তু, টগরদের ভাই বলিহারি যাই, বারোমাস ডালে ডালে তাদের থোকা থোকা ফুল, ফাঁকিটা কিছুতেই আর শেখানো গেল না! মেয়েগুলো সব পুটুস পুটুস ফুল তুলে পটাপট মালা গাঁথত যখন-তখন—স্বয়ম্বরা হতে নয়, নিজেদের গায়ে-গলায় পরে আজব শখ মেটাতে। আমার মতো অলপ্পেয়েও তুলে আনত মুঠো মুঠো ফুল, জলভেজা ন্যাতা শুকিয়ে গেলে সেই ফুল রগড়ে শেলেট মুছত সারাদিন। আর যারা ঠিক আমার মতো নয়, তারা এই টগর দিয়ে সাক্ষী মেনে ঘটা করে একে অপরের স্যাঙাৎ হত, ‘ফুল’ পাতাতো।
‘ফুল’ পাতাতে লাগত শুধুই ফুল, যে-কোন ফুল। আমাদের ছিল অঢেল টগর। অল্পদিনেই পাঠশাল যেন হয়ে উঠল ‘ফুলে’র কেয়ারিবাগ, এ-ওর ‘ফুল’, সে-তার। কেবল আমার পোড়া কপালে তখনও কোন ‘ফুল’ জোটেনি, হয়তো তেমন গা-করিনি বলে। কিন্তু, পয়ার তো আর অমিল থাকে না, মিল খুঁজে নেয় ঠিক। আমারই এক সহপাঠী, ফাঁকিবাজিতে আমার চেয়ে এককাঠি। কোত্থেকে পাক্কা ঠাকুমা-ভাবের এক সহপাঠিনীকে খুঁজে পেতে ধরে আনল। ‘ফুল’ পাতিয়ে পাতিয়ে সে-নাকি বুড়ি! তার কথাটুকুনিই নাকি শাস্তর বাক্যি; সুতরাং, শিরোধার্য। তাই সে যেমন-যেমন বলল, আমরা তেমন-তেমন করলাম। সে আচার বড় সহজ—
আমরা দুই বন্ধু মুখোমুখি বসলাম, দুজনের দুই হাতে ফুল। ও আমার দুই কানে ফুল গুঁজে দিল, আমি দিলাম তার। তারপর আমার ডান হাতের কড়ে আঙুলে তার ডান হাতের কড়ে আঙুল ছুঁইয়ে ও আমায় বলল, ‘ফুল’। আমি বললাম, ‘ফুল’। ব্যাস, এই। এতেই, আমরা দু'জনে ‘ফুল’ হয়ে গেলাম।
একবার ‘ফুল’ পাতানো হয়ে গেলে আর একে-অপরের নাম ধরে ডাকা চলে না। সে আমায় ডাকে ‘ফুল’, আমিও তাকে তাই ডাকি। শুরু হল পাঠশালে দু'জনে পাশাপাশি বসা, জলে-জঙ্গলে-ডাঙ্গায় একসঙ্গে ঘোরা। যাকে বলে, হরিহর আত্মা--এ হল যেন তা-ই। দু'জনের বুকের সিন্দুকে জমতে লাগল এক-একটি করে দু'জনের গোপন প্রানের কথা, বাইরের আর-পাঁচজন সে-সব টেরটিও পেল না। কিন্তু, তখন কী আর জানতাম কিশোরীর মতন উচ্ছল আমাদের সেই নদীটার পেটে পেটে এত! সে কুল ভেঙে বেমালুম গিলে ফেলবে আমাদের প্রিয় টগরের গাছ, পাঠশালার ঘরদোর; আর তার স্রোতের আবর্তে পাক দিতে দিতে বয়ঃসন্ধি পার দুজনকে দুই কিনারায় এনে ফেলবে! কিন্তু, নদী যে কারও কথা শোনে না!
পাঠশালার পাড় ভাঙল, টগরের বাগান হারিয়ে গেল। আর তারই মাঝে এই নদীরই পাড় ঘেঁষে আমাদের যে বাড়ি, সেখানে বসন্তের আকাল হল না। সেখানে ‘ফুলে’র ছড়াছড়ি। বাঁকুড়ার সেই বাড়িটাকে তখন যদি কেউ ‘ফুলবাড়ি’ বলতে চাইত, বলতেই পারত। কারণ, আমার মা-বাবা-জেঠা-জেঠি-দাদা-দিদিদের সকলেরই ‘ফুল’ ছিল। মায়ের ‘ফুল’কে আমরা ‘ফুলমা’ বলতাম। জেঠার ফুলকে বলতাম ‘ফুল জেঠা’ আর জেঠিমার ফুলকে ‘ফুল জেঠি’। কেবল, দাদা-দিদিদের ফুলেদের সঙ্গে ‘ফুল’-ঘটিত কোন সম্পর্ক হত না।
যদিও স্ত্রীপুরুষে ‘ফুল’ পাতাতে সচরাচর দেখা যেত না, কিন্তু, আমার বাবা ছিলেন এর ব্যতিক্রম। তাঁর ‘ফুল’কে আমরা বলতাম ‘ফুলকাকি’। বাবা একবার পুরী গিয়েছিলেন, সহযাত্রী ছিলেন আমার ফুলকাকি। সেখানে একা মেয়েমানুষ ফুলকাকি বেশ বিপদে পড়েছিলেন, বাবা জানতে পেরে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সাহায্যের হাত। তাতেই একদিন ফুলকাকি ইচ্ছে জানিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে ‘ফুল’ পাতানোর। তখন তাঁরা সাক্ষী গোপালে। দু'জন দু'জনের হাতে ফুল দিয়েছিলেন, বলেছিলেন—
‘সাক্ষী গোপাল তুমি সাক্ষী,
আমরা দুজন ফুল পাতাচ্ছি।’
এ তো গেল আমার চেনা, আমার শোনা, আমার জীবনচর্যার 'ফুল' বাগানের কথা। এ-বার শুনব অন্যের অভিজ্ঞতার কথা। স্থান বদলে যে, আচারেরও বদল ঘটে--জানতে পারব তারও কথা। বাঁকুড়ার শিলাবতীর তীরে আমাদের গ্রাম ছাড়িয়ে ঝাড়গ্রাম--গাড়িতে বড়জোর ঘন্টা দু'য়ের পথ। সেখানকার শাঁখাভাঙা গ্রামের এক আদিবাসী পরিবারে একবার আতিথ্য নিয়েছিলেন রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে ছিলেন সাহিত্যিক সমরেশ বসুর মেয়ে বুলবুল। আদিবাসী পরিবারটিতে পার্বতী নামে বুলবুলের সমবয়সী একটি মেয়ে ছিল। কণিকা এই আতিথ্যের-বন্ধনটিকে সম্পর্কেরবন্ধনে বাঁধতে উদ্যোগ নিলেন। বুলবুলের সঙ্গে পার্বতীর সই-পাতিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে জানালেন পরিবারের মেয়েদের কাছে। ব্যস, মহানন্দে শুরু হয়ে গেল আয়োজন। কণিকা তাঁর 'আনন্দধারা'-বইতে এই আয়োজন ও আচারের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা হুবহু তুলে দিলাম :
"চারপাশে মাটির ঘর, তার মাঝখানে বড় আকারে খোলা আঙিনা। মাটির দাওয়ায় পার্বতীর আত্মীয় স্বজন বন্ধুরা বসলেন। আমরা মুখোমুখি একটি দড়ির খাটিয়াতে সবাই বসলাম। পার্বতী আর বুলবুল বসল পাশাপাশি আর একটি খাটিয়াতে। আমরা 'সই পাতানো' বললেও সাঁওতালরা এটাকে বলে 'ফুল পাতানো'। ...এক বয়োজ্যেষ্ঠা মহিলা একটা বড় কাঁসার পাত্রে জল আনলেন। বুলবুল আর পার্বতী যে খাটিয়ায় বসেছিল, জলের পাত্রটি সেই খাটিয়ার সামনে মাটিতে রাখা হল। বয়োজ্যেষ্ঠা মহিলা বুলবুলের পা দুটো ওই পাত্রের জলে ডুবিয়ে দিলেন...পরিষ্কার করে ধুয়ে দিলেন। ঠিক ওইভাবেই পার্বতীর পা দুটিও ধোয়ানো হল। এরপর পার্বতীর শাড়ির আঁচলের সঙ্গে বুলবুলের শাড়ির আঁচলের গিঁট বাঁধা হল। ...গাঁদাফুলের মালা দুটি পরিয়ে দেওয়া হল ওদের দুজনের গলায়। ওরা মালাবদল করল। এই পা ধোয়া, মালাবদল সবকিছুকে কেন্দ্র করেই গান গাইছিল বাড়ির মেয়েরা, এক ধারে, এক সারে দাঁড়িয়ে। গান চলেছিল অনুষ্ঠানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। মালাবদলের পর মিষ্টিমুখের পালা। আমাদের সঙ্গে অনেক খাবার, মিষ্টি ছিল। সেই মিষ্টি একটা করে বুলবুল, পার্বতী পরস্পরকে খাওয়াল। এবার বুলবুল প্রণাম করল পার্বতীর মাবাবাকে। পার্বতী প্রণাম করল আমাকে। তখন থেকে পার্বতীর মা, বাবা বুলবুলের ফুল-মা, ফুল-বাবা হলেন। আমি হলাম পার্বতীর ফুল-মা। এবার আসল কাজ ওদের আঁচলের গিঁট খোলা। ওদের নিয়ম হল, এক পক্ষের কোনও বয়স্কা মহিলা আঁচলের গিঁট খুলে দেবেন এবং তার পরিবর্তে অপরপক্ষের থেকে টাকা দাবি করবেন। যতক্ষণ পর্যন্ত এই দাবি না মেটানো হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত গিঁট খোলা হবে না। এটা একটা কৌতুক। পার্বতীর বৌদি, মা, কাকিমাস্থানীয় একজন গিঁট খোলার জন্য আমার কাছে টাকা দাবি করলেন। আমি হেসেই টাকা মিটিয়ে দিলাম। তিনি খুলে দিলেন বুলবুলদের আঁচলের গিঁট। এখন থেকে বুলবুল আর পার্বতী দুজন সই অর্থাৎ পরস্পরের 'ফুল' হয়ে গেল।"
বিয়ে বা রক্ত সম্পর্কের বাইরে এভাবে বন্ধুত্ব পাতানোর মধ্য দিয়ে বাঙালি শুধু যে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে সম্পর্ক তৈরি করত তা নয়; গড়ে তুলত পারিবারিক সম্পর্ক, সামাজিক বন্ধন। সেই পরিবারগুলোর মধ্যে উৎসব-অনুষ্ঠানে আসা-যাওয়া চলত, উপহার দেওয়া-নেওয়া হত। এখনো টিম টিম করে কোথাও কোথাও বজায় আছে এই সম্পর্ক তৈরির ধারা। লোক-লৌকিকতার মধ্য দিয়ে এই যে ব্যক্তি ছাড়িয়ে পারিবারিক সম্পর্ক; লোকে সেই সম্পর্কের নাম দিয়েছে—‘ফুল পরাণ’।