এক আশ্চর্য বুড়ো। তাঁর বাড়িতে আছে হিরে-মানিকের মত মূল্যবান রত্ন। তাঁর গবেষণার কাগজপত্র। আর তার সঙ্গে নানা অদ্ভুত সব জিনিস। যেমন - এক রোবট যে নাকি অংক কষতে পারে। নাম 'রোবু'। আবিষ্কার করেছেন মানুষের কঠিনতম রোগ সারানোর ওষুধ 'মিরাকিউরল'। এছাড়াও আরও চমৎকার সব জিনিসপত্র তাঁর গবেষণাগার আলো করে রয়েছে।
সেদিন এই আশ্চর্য বুড়োর পঁচাত্তর তম জন্মদিন। তাঁর এক টক-মিষ্টি বন্ধু আছে। অবিনাশবাবু। সেদিন সকালে প্রথম উইশ করলেন সেই বৃদ্ধ মানুষটিকে। ''মেনি হ্যাপি ডেজ অফ দ্য রিটার্ন''। এমন ভুল ইংরেজি শুনতে অভ্যস্ত সেই বৃদ্ধ মানুষটি। আর তাঁর বন্ধু ভুল ইংরেজি বলতে অভ্যস্ত।
জন্মদিনে এক আশ্চর্য রহস্যের মুখোমুখি হলেন সেই পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধ। এক অত্যন্ত মেধাবী বিজ্ঞানী প্রশান্ত মহাসাগরের একটি দ্বীপে অপঘাতে মারা গেছেন। মৃত্যুর কোন সম্ভাবনাই ছিল না নাকি। এই মৃত বিজ্ঞানীর ছেলে ওই বৃদ্ধ মানুষটিকে অনুরোধ করেছিলেন এই মৃত্যু রহস্যের সমাধান করতে।
কিন্তু সমাধান আর হয়নি। কেন? আসলে ওই বৃদ্ধ মানুষটির সৃষ্টিকর্তা এই গল্পটি আর সম্পূর্ণ করতে পারেননি।
কে এই বৃদ্ধ গবেষক যার গবেষণাগার এক আশ্চর্য, অলীক জগত? প্রোফেসর শঙ্কু। আর এই চরিত্রের সৃষ্টিকর্তা? সত্যজিৎ রায়।
উপরের গল্পের অংশটি সত্যজিৎ রায়ের প্রোফেসর শঙ্কু সিরিজের শেষ গল্প। অসম্পূর্ণ। ১৯৯১ সালে এটি লিখেছিলেন সত্যজিৎ রায়।
সন্দীপ রায়ের কথায় ''বাবা গল্পটি পরপর তিনবার লেখার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু প্রতিবারই তা অসম্পূর্ণ থেকে যায়''।
তবে এই অসম্পূর্ণতার আমাদের ছেলেবেলাকে সম্পূর্ণ করতে কোন অসুবিধা হয়নি। প্রোফেসর শঙ্কু মানেই নস্ট্যালজিয়ায় মোড়া কল্পবিজ্ঞান।
প্রোফেসর শঙ্কু স্কটিশ চার্চ কলেজের অধ্যাপক। পুরো নাম ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু। আবির্ভাব ১৯৬১ সালে।
সন্দেশ পত্রিকার পাতায় প্রথম এই কল্পবিজ্ঞানের সুপারহিরোর জন্ম। জন্মদাতা মানিকবাবু অর্থাৎ সত্যজিৎ রায়।
প্রথম কাহিনীতে ডায়েরির আকারে প্রোফেসর শঙ্কু নিজেই বলেছেন নিজের কাহিনী।
জন্মের শুরু থেকেই শঙ্কু কাহিনী কিশোর পাঠকদের মন জয় করেছে। সন্দেশ পত্রিকার মিষ্টত্ব খানিক বেড়ে গিয়েছিল শঙ্কুর কাহিনীর দৌলতে।
মাথায় অল্প সাদা চুল। গোল টাক। গোল ফ্রেমের চশমা। পরনে কোর্ট ও ঢোলা প্যান্ট। খ্যাপাটে বুড়ো। বাড়ি বিহারের গিরিডি অঞ্চলে। প্রতিবেশীরা অনেকেই তাঁকে নানা অদ্ভুত কাজকর্ম করতে দেখেন। এই যেমন কখনো নদীর ধারে আপন-মনে বিড়বিড় করতে করতে হেঁটে বেড়ান। কখনো নিজের বাগানের ফুলের দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকেন। অদ্ভুত মানুষটাকে সর্বক্ষণ আগলে রাখেন তাঁর পুরনো, অত্যন্ত বিশ্বস্ত সর্বক্ষণের সঙ্গী প্রহ্লাদ। আর তাঁর সঙ্গী একটা বিড়াল। নাম নিউটন। এমনটাই সত্যজিৎ রায়ের কলমে প্রোফেসর শঙ্কুর অবয়ব।
এই বৈজ্ঞানিক ও আবিষ্কারক মানুষটি খাঁটি বাঙালি। আত্মভোলা, প্রচন্ড সংযমী। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী মহলে তিনি সসম্মানে গৃহীত হয়েছেন। তাঁর আত্মপ্রত্যয় ও বিচিত্র উদ্ভাবনী প্রতিভা অবাক করে।
প্রোফেসর শঙ্কুর আবিষ্কারের পদ্ধতি যেমন অদ্ভুত, তাঁর আবিষ্কারের নামগুলোও বেশ অন্যরকম। অ্যানাইহিলিন, মিরাকিউরল, নার্ভিগার, অমনিস্কোপ, লিঙ্গুয়া গ্রাফ। কোনটা ওষুধ কোনটা আবার যন্ত্র।
মানুষের জীবনের যেকোনো সমস্যা তুড়ি মেরে সমাধান করতে পারে এই আবিষ্কার গুলো। গবেষণা ও আবিষ্কারের সূত্রে প্রোফেসর শঙ্কুর বিচরণ সারা বিশ্বজুড়ে।
শুধুমাত্র কল্পবিজ্ঞানের কাহিনী বলে প্রোফেসর শঙ্কুর গল্পগুলোকে বর্ণনা করা যায় না। এ যেন এক অন্যরকম জাদু-বাস্তব।
বাস্তবের মতো লোভ, লালসা, সততা, স্বচ্ছতা রয়েছে গল্পের চরিত্রগুলোর মধ্যে। কল্পবিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলো ম্যাজিকের মত কখনো ভালো মানুষকে রক্ষা করেছে আবার কখনো দুষ্টু লোককে দিয়েছে শাস্তি।
এছাড়াও এই কাহিনীগুলোতে মিশে রয়েছে ভ্রমণ, রহস্য ও অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ। কোন গল্প দুরন্ত অভিযান, কোনটা আবার পুরোপুরি ফ্যান্টাসির রোমাঞ্চ।
প্রোফেসর শঙ্কুর কল্পবিজ্ঞানের কাহিনী মানেই এক আশ্চর্য জগত। একবার ঢুকে পড়লেই বয়স নামের এই জগদ্দল পাথরটার ভার দুম করে নেমে যায়। হালকা লাগে নিজেকে। যেকোনো বয়সের পাঠককেই তার কিশোরবেলা উপহার দিতে পারে প্রোফেসর শঙ্কু।
১৯৯২ সাল পর্যন্ত শঙ্কুর আটত্রিশটি সম্পূর্ণ এবং দুটি অসম্পূর্ণ ডায়েরি প্রকাশিত হয়েছে।
কল্পবিজ্ঞানের এই আশ্চর্য জগতে প্রোফেসর শঙ্কুর অবস্থান দৃঢ় অথচ ভারহীন। পাঠককে পালকের মতো হালকা রাখতে এই সুপারহিরোর জুড়ি মেলা ভার।