পাপিয়া কর সরকারের স্বীকৃত হস্তশিল্পী। নদীয়ার মাজদিয়ার মেয়ে। রানাঘাট লোকালে করে শীতকালে মেলার জন্য কলকাতায় যাতায়াত ছিল তাঁর। একদিন শীতের রাতে কলকাতা থেকে ফিরছিলেন রানাঘাট লোকালে করে। রানাঘাট স্টেশনে নেমে এক বৃদ্ধাকে দেখে তার অভুক্ত বলে মনে হয়। তবে সেই বৃদ্ধ া কোন গরীব পরিবারের মানুষ ছিলেন বলে পাপিয়া করের মনে হয়নি, বরং কোন সচ্ছল পরিবারের অসহায় একজন মানুষ। পাপিয়া করের অন্তত তাই মনে হয়েছিল। বেশ খানিকক্ষণ ইতস্তত করে পাপিয়া সেই বৃদ্ধার হাতে দশটি টাকা তুলে দিয়েছিলেন। সেদিন রাতের খাবার কেনার জন্য। মাত্র ১০ টাক ায় কী খাবার পাওয়া যায়? সেই বৃদ্ধা টাকাটি হাতে নিয়ে পাপিয়া করকে বলেছিলেন গত ১০ দিন যাবত তিনি বাড়িতে খেতে পাননি। কিন্তু সেই মুহূর্তে সেই বৃদ্ধার হাতে তুলে দেওয়ার মত কোন বাড়তি টাকা পাপিয়ার কাছে ছিল না। তবে পাপিয়া সেই বৃদ্ধাকে কথা দিয়েছিলেন যে পরের দিন নিজে হাতে রান্না করে সেই বৃদ্ধার জন্য নিয়ে আসবেন। পরের দিন কাজ থেকে ফেরার পথে যথাসময়ে একটি টিফিন বক্স হাতে নিয়ে রানাঘাট স্টেশনে সেই বৃদ্ধাকে খুঁজতে থাকেন পাপিয়া কর। কিন্তু কোথায় সেই বৃদ্ধা? পাপিয়া কর জানতে পারেন সেই বৃদ্ধা গতকাল রাতেই মারা গেছেন।
দশ দিন না খেয়ে থাকা বৃদ্ধা আর বাঁচতে পারেনি পাপিয়ার কিনে দেওয়ার টাকার খাবারেও। হঠাৎ পাপিয়ার মনে হয় সেই অজানা, অপরিচিতা, অভুক্ত বৃদ্ধার মত আরও এমন অনেক অভুক্ত মানুষ রয়েছে যারা হয়তো ঠিক সময়ে খাবার না পেয়ে ধীরে ধীরে পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছেন। স্বামীর সঙ্গে কথা বলে সেদিন থেকে পাপিয়া কর শুরু করেন ‘অন্নপূর্ণা সরাই ঘর’। প্রথমে রানাঘাটের মাজদিয়া অঞ্চলের দুঃস্থ পরিবারের ১০ থেকে ১৫ জন সদস্যকে প্রতিদিন নিজে হাতে রান্না করে খাওয়াতেন পাপিয়া। তারপর স্বামীর সাহায্যে নিজে আরো নানা কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পাপিয়ার সরাই-ঘরে খেতে আসা মানুষদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এখন প্রতিদিন পাপিয়া প্রায় ১০০ জনকে নিজের সরাই ঘরে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়ান।
সরকারি বা বেসরকারি কোন সংস্থার সঙ্গেই পাপিয়া যুক্ত নন। পাপিয়া কর সরকারি স্বীকৃত হস্তশিল্পী। বিভিন্ন অঞ্চলে মেলা এবং অন্যান্য হস্তশিল্পের কাজে তিনি সরকারের তরফে যুক্ত হন। সোখান থেকে যা রোজগার হয় তা দিয়ে এবং স্বামীর সাহায্যে তিনি প্রতিদিন এখনও রানাঘাট অঞ্চলের দুঃস্থ মানুষদের খাইয়ে চলেছেন রোজ।
পাপিয়া করের কাজ এখন আর শুধু রানাঘাট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ নেই। ধর্মতলার মেট্রোর কাছে যে সমস্ত ছেলেমেয়েরা অভাবী বা অনাথ তাদের নিয়মিত পড়াশোনা শেখাতে আসেন পাপিয়া। শুধু পড়াশোনা শেখানো নয় এদেরকে জীবনের উত্তরণের পথ দেখান পাপিয়া কর। এই সমস্ত ছেলেমেয়েরা বেশিরভাগই বিভিন্ন নেশার কবলে পড়ে থাকেন নইলে নানান অসামাজিক কাজকর্মে যুক্ত হওয়ার পথে এগোতে থাকেন। এঁদের আর্থিক অবস্থা একেবারেই ভালো নয়। পাপিয়া নিয়মিত এদের মানসিক কাউন্সিলিং করে এখনো এঁদের জীবনের পথে ফেরানোর চেষ্টা করে চলেছেন। পাপিয়ার এই কাজ নানা সংবাদমাধ্যমে এবং মিডিয়ায় আলোচিত হয়েছে।
সরকারি বিভিন্ন সাহায্যের কথাবার্তাও চলেছে। তবে পাপিয়া আজও নিজের উদ্যোগেই নিজের সেবাব্রতের পথে এগিয়ে চলেছেন। দুঃস্থ, অভাবী মানুষের কাছে পাপিয়া কর এক আলোর নাম।