আলো ঝলমলে উৎসবের আড়ালে চাপা পড়ে থাকে ৩০০ বছরের অচেনা ইতিহাস

কাঠ-বাঁশ-হাতুড়ি’র ঠুকঠুক শব্দ। কাঠামোর গায়ে মাটি-রঙের প্রলেপ। আকাশে বাতাসে পুজো পুজো গন্ধ। চারপাশে তাকালে মন ভাল হয়ে যায়। শুরু হয়ে যায় দিন গোনা। আলোর রোশনাই, ঢাকের বোল আর উৎসবের উচ্ছ্বাস। পুষ্পাঞ্জলির ফুল হাতে নিলেই বুকের ভিতর থেকে উঠে আসে রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি

আলো ঝলমলে উৎসবের আড়ালে চাপা পড়ে থাকে ৩০০ বছরের অচেনা ইতিহাস। তার গায়ে অজস্র দীনহীন মুখের ঘাম-শ্রম আর দম চাপা কষ্টের দাগ। চাবুকের ঘা খেয়ে ঘরে ফেরার গল্প। সেকালের কলকাতায় বাবুদের বাড়িতে দেবী দুর্গার মুখ দেখার অধিকার ছিল না সব শ্রেনীর মানুষের। সেই পুজোতে কেবলমাত্র অতিথিরাই প্রবেশ করতে পারতেন।

জমিদার বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে থাকত দারোয়ান লেঠেল। লাঠির সঙ্গে মজুত থাকত চাবুকও। অতিথি ছাড়া আর কেউ ঠাকুর দেখতে বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করলেই সেই চাবুক হুঙ্কার দিয়ে উঠত। বচ্ছরকার দিনে মাটির মায়ের মুখ দেখতে চেয়ে চাবুক খেয়ে ঘরমুখো হতে হত গরিব-গুর্ব মানুষগুলোকে। মাছি তাড়াবার মতো করে সরিয়ে দেওয়া হত তাদের উপস্থিতি।

ভিতরবাড়িতে জমে উঠত বাইনাচের আসর। বিদেশি সাহেবের জন্য বিপুল প্রমোদ আয়োজন। কিন্তু এই ব্যবস্থা বেশিদিন স্থায়ী হল না। ভাঙন এলো একতরফা মোশাহেবি মোচ্ছবে। ধনী-বনিক-তাঁবেদার- মোসাহেব দের নাট মন্দিরের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এলেন মা। দীন-হীন মানুষের মাঝে। যেখানে তাঁর ধূলার আসন পাতা।

হুগলীর গুপ্তিপাড়ায় ১২ জন বন্ধু নিজেরা চাঁদা তুলে আয়োজন করলেন দুর্গোৎসবের। সেখানে সাধারণের প্রবেশে কোনও বাধা-বেড়ি নেই। সালটা ১৭৯০। বারো জন ‘ইয়ার’ মানে বারো জন বন্ধুর উদ্যোগে শুরু হয়েছিল বলে নাম হয়- ‘বারো ইয়ারী’। বাংলায় প্রচলন হল বারোয়ারি পুজো। সেই প্রথম। আরও ১০০ বছর পর কলকাতায় বারোয়ারী ধাঁচের দুর্গোৎসব শুরু করেন কাশিমবাজার রাজবাড়ির রাজা হরিনাথ। ১৯১০ সালে ভবানীপুরের বলরাম বসু ঘাট রোডে ভবানীপুর সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভার পক্ষ থেকে বারোয়ারি দুর্গাপূজা আয়োজিত হয়।  এই পুজো আজও হয়ে আসছে।  বারোয়ারি দুর্গোৎসব পরে চেহারা নিল সার্বজনীন-এ। ১৯২৬ সালে এই কলকাতা শহরেই। উত্তর কলকাতার সিমলা এবং বাগবাজার অঞ্চলে।

FotoJet - 2019-09-20T185657.899

সিমলা অঞ্চলের পুজোর প্রাণ পুরুষ অতীন্দ্রনাথ বসু। তিনি ছিলেন অরবিন্দ ঘোষের শিষ্য‌। এই পুজোর প্রথম প্রতিমা তৈরি করেন মৃৎশিল্পী নিতাই পাল। এক চালার মাতৃমূর্তি। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, স্যার হরিশঙ্কর পালের মতো বহু বিখ্যাত মানুষ জড়িয়ে ছিলেন এই পুজোর সঙ্গে । স্বদেশী ভাবনায় সিমলা ব্যায়াম সমিতির পুজোয়  প্রতিমাকে তখন খাদি বস্ত্র পরানো হতো।

বাগবাজারের দুর্গাপুজোতেই সার্বজনীন শব্দটি প্রথম ব্যবহার করা হয়। আগে ছিল বারোয়ারি পুজো। ১৯১৮-১৯ সালে নেবুবাগান বারোয়ারি দুর্গাপুজো নামে চেনা যেত বাগবাজারের পুজো। এই পুজোর ইতিহাসেও মিশে লাঞ্ছনার কাহিনি। স্থানীয় কিছু যুবক এক ধনী বাড়িতে পুজো দেখতে গিয়ে অপমানের সম্মুখীন হন। ফিরতি শরতে তাঁরা নিজেরাই শুরু করেন দুর্গোৎসব। ১৯৩৬ সালে নেতাজি স্বয়ং পুজোর সভাপতিত্ব করেন। উত্তরের দুই পুজোতেই ছিল সরাসরি স্বদেশী সঙ্গত । রক্ষনশীল পণ্ডিত মহলের প্রতিবাদের মুখেও পড়তে হয়। কিন্তু পণ্ডিত দীননাথ ভট্টাচার্‍্যের হস্তক্ষেপে সেই বিরোধীতা বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারেনি। পুজোর পাঁচদিন যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে স্বদেশী ভাবনা জাগিয়ে তুলতে শারদ উৎসব হাতিয়ার হয়েছিল। তখন তিনি শুধু ঘরের মেয়ে উমা নন, তিনি দেশমাতৃকা।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...