বাংলাজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য মন্দির, নানান লোকশ্রুতি ও কিংবদন্তির মিশেলে মন্দিরেরা হয়ে ওঠে মিথ। এমনই একটি মন্দির হল পশ্চিম বর্ধমানের আসানসোল এলাকার কল্যাণেশ্বরী মন্দির। ঠিক কোন কল্যাণেশ্বরী মন্দির তৈরি হয়েছিল, তার কোন প্রমাণ আজও মেলেনি। কল্যানেশ্বরী মন্দির, বরাকর নদীর ধারে পশ্চিমবঙ্গ এবং ঝাড়খণ্ড সীমান্তে আসানসোলের কাছেই অবস্থিত এই মন্দির। এখানে মা কালিকে শক্তি রূপে পুজো করা হয়। শোনা যায়, ১২০০ বছরের পুরনো এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মহারাজা বল্লাল সেন। মন্দিরের প্রাচীন তথ্য থেকে জানা যায়, খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে কাপালিক দেবদাস চট্টোপাধ্যায় মা কালীর সাধনা করার জন্য এখানে আসেন। সেই সময় এই এলাকায় ছিল ঘন জঙ্গল। শোনা যায়, রাজা বল্লাল সেন ছিলেন ওই সাধকের ভক্ত। কালী সাধকের নির্দেশ মেনেই তিনি অধুনা শ্রবনপুরে মন্দির নির্মাণ করেন। সেখানেই বহু বছর আরাধনা হয় দেবী শ্যামারূপার। শ্রবণপুরে জনবসতি গড়ে উঠলে দেবী নাকি কোলাহলে রুষ্ট হয়ে কল্যাণেশ্বরী একটি একফুট গভীর গর্তে আশ্রয় নেন। সেই সময় থেকে ওখানেই পূজিত হচ্ছেন মা কল্যাণেশ্বরী।
কল্যাণেশ্বরী মন্দিরে কোন মূর্তি পুজো হয় না। এখানে রয়েছে একটি বড় পাথর। তার তলায় আছে একটি অদৃশ্য গুহা। পাথরের এক কোনায় একটি গর্ত রয়েছে। ভক্তদের বিশ্বাস, ওই গর্ত ছুঁয়ে দেখলেই দেবীর আশীর্বাদ লাভ করা যাবে। ১২০০ বছর ধরে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মন্দির প্রাঙ্গণে আসছেন ভক্তরা। মা কালি রাজার স্বপ্নে অনেকবার এসেছিলেন। পরে একদিন বরাকর নদী থেকে এক জোড়া চুড়ি পরা হাত উঠে আসতে দেখা যায় এবং এখানে মায়ের পায়ের ছাপ পাওয়া যায়। যা এখনও রয়েছে। এই ঘটনার পরে রাজা বিশাল বড় করে এই মন্দির তৈরি করেন।
কল্যাণেশ্বরী মহাশক্তি পুজো প্রায় ৫০০ বছর যাবৎ হয়ে চলেছে। এককালে এখানে নরবলির হত বলেও জানা যায়। পরবর্তীতে তা বন্ধ হয়ে ছাগল বলি দেওয়ার রীতি চালু হয়। তবে মন্দির আরও পুরোনো। পঞ্চকোট রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় মন্দির তৈরি হয়। কল্যাণেশ্বরী খুবই জাগ্রত দেবী। সন্তানহীন মহিলারা তার কাছে প্রার্থনা করলে তাদের সন্তানেচ্ছা পূর্ণ হয় বলেই মানুষের বিশ্বাস। সন্তানলাভের আশায় এই মন্দিরে মহিলাদের সমাগমই বেশি। তাঁদের বিশ্বাস, কল্যানেশ্বরীতে পুজো দিলে মা কালি প্রসন্ন হবেন। কল্যাণেশ্বরী মন্দির পশ্চিম বর্ধমান জেলার আসানসোলে অবস্থিত।
মন্দির তৈরির নেপথ্যে রয়েছে ইতিহাস। তৎকালীন সময়ে এই জায়গার রাজা হরিপদ গুপ্ত এই মন্দির তৈরি করেন। পরবর্তীতে পঞ্চকোটের রাজা এই মন্দিরের পুনর্নির্মাণ করেন। কল্যানেশ্বরী মন্দির নিয়ে ভক্তদের মধ্যে বিভিন্ন অদ্ভুত গল্পের প্রচলন রয়েছে। শোনা যায়, এক চুড়িওয়ালা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় একটি বাচ্চাকে বসে থাকতে দেখে। মেয়েটি তার চুড়ি কিনতে চায়। মেয়েটির কাছ থেকে টাকা চাইলে সে দেখিয়ে দেয় রাজবাড়ির রাজাকে। আগের দিন রাতেই মা কালি সাক্ষাৎ রাজার স্বপ্নে এসে বলেন, তাঁর এক জোড়া চুড়ি চাই। সেই টাকা পরেরদিন চুড়িওয়ালা চাইতে এলে রাজা দিয়ে দেন। আগের দিনের স্বপ্ন ফলে যায়। এই ঘটনার পরেও মা কালি রাজার স্বপ্নে অনেকবার এসেছিলেন। পরে একদিন বরাকর নদী থেকে এক জোড়া চুড়ি পরা হাত উঠে আসতে দেখা যায় এবং এখানে পায়ের ছাপ পাওয়া যায়। যা এখনও রয়েছে। এই ঘটনার পরে রাজা বিশাল বড় এই মন্দির তৈরি করেন। এখানে যে যা মানত করেছেন, সবই পেয়েছেন বলে দাবী ভক্তদের।
এই মন্দিরের নরবলির নেপথ্যে রয়েছে এক রোমহর্ষক কাহিনী। এক গরীব ব্রাহ্মণ এবং তাঁর পরিবার ভক্তিভরে পুজো করতেন। নিজের হাতে প্রসাদ খাওয়াতেন। একদিন পুজো হওয়ার আগেই খাবার জোগাড় করতে মেয়েকে ঠাকুরের সামনে বসতে বলে বেরিয়ে পড়েন। দেবী অপ্রসন্ন হয়ে ব্রাহ্মণের মেয়েকে মেরে ফেলেন। পরে মা কালির অনুশোচনা হয়। মা কালি আশীর্বাদ করে বলেন, এখন থেকে এই মন্দিরে যে এসে সন্তানের জন্যে প্রার্থনা করবে, তার সন্তান লাভ হবে। এর পাশাপাশি ব্রাহ্মণকে তাঁর মেয়ের প্রাণও ফিরিয়ে দেন। প্রতি বছর কালীপূজোর সময় জাঁকজমক করে এই মন্দিরে পুজো হয়। ভোগ বিতরণ চলে। কল্যানেশ্বরী মন্দির নিয়ে ১৯৮২ সালে একটি বাংলা ছবিও তৈরি হয়েছিল।
পাহাড় জঙ্গল ও নদী ঘেরা সুপ্রাচীন এই মন্দিরটি ছিল সাধকের সাধনস্থল। সাধকের নিভৃত সাধনার অন্যতম স্থান ছিল এই ক্ষেত্র।তান্ত্রিক সাধকগণ এখানে সাধনা করে কল্যাণেশ্বরী মায়ের থান প্রতিষ্ঠা করেন। সিদ্ধচৈতন্য নামক এক সাধক এখানে এসে সাধনা করেন এবং মাতৃবিগ্রহ রাখেন যদিও মতান্তর রয়েছে। পরে পঞ্চকোট রাজাদের কুলদেবী হন মা কল্যানেশ্বরী। সুবর্ণনির্মিত ছোট্ট কালী বিগ্রহ।বিগ্রহটি আচ্ছাদনের নীচে থাকে। মাতৃবিগ্রহের ছবি তুলতে দেওয়া হয় না। তাই সেই আচ্ছাদনের ছিল দেওয়া আছে। এখানে কল্যাণেশ্বরী মায়ের শাখা পরার ঘটনা আছে। প্রতি বছর দুর্গাষ্টমীতে মায়ের শাঁখাপরার অনুষ্ঠান উদযাপিত হয়। দুর্গাপুজোর সময়ে নবমীর দিনে ধুমধামের সঙ্গে দেবীর পুজো হয়। মাতৃদর্শনকৃপালাভে ধন্য হয় ভক্তেরা।
অনেকে মনে করেন, কাশিপুরের রাজা এই মন্দির স্থাপন করেছিলেন। জনশ্রুতি, কাশীপুরের এক রাজা বিবাহের যৌতুক হিসেবে দেবী কল্যাণেশ্বরীকে পান। দেবী কল্যাণেশ্বরীর বিগ্রহ ও রাজবধূকে পাল্কিতে করে নিয়ে আসা হয়েছিল। তার পরে সবনপুর এলাকায় দেবীর মন্দির তৈরি করা হয়। সবনপুর এলাকায় একটি মন্দিরের চিহ্ন এখনও রয়েছে। লোকশ্রুতি অনুসারে, প্রথমে সেখানেই বিরাজমান ছিলেন দেবী কল্যাণেশ্বরী। এই মন্দির পুরনো কল্যাণেশ্বরী মন্দির নামে পরিচিত। কথিত রয়েছে প্রাচীন আমলে এই গ্রামের নাম ছিল স্বপ্নপুর। পরে তাই লোকমুখে সবনপুরে রূপান্তরিত হয়। হয়ত এক সময় এখানে তান্ত্রিকদের একটা বড় ঘাঁটি ছিল। লোকমুখে প্রচলিত কাহিনী অনুসারে, সবনপুরের চারপাশে ছিল গ্রাম। সেখানে নাকি সারাদিন ধান থেকে চাল ও চিড়ে তৈরি করা হত। ঢেকির আওয়াজে দেবী কল্যাণেশ্বরী বিরক্ত হয়ে কাশিপুর রাজাকে স্বপ্নাদেশে বলেন, তাঁকে অন্যত্র স্থানান্তরিত করতে। দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে রাজা নিকটবর্তী একটি জঙ্গলে দেবীর মন্দির স্থানান্তরিত করেন। এরপরেই জঙ্গলকে ঘিরে গড়ে ওঠে সিদ্ধপীঠ। এই মন্দিরটিই আজ কল্যাণেশ্বরী মন্দির নামে পরিচিত। আজও এখানে এক ছোট গুহার মধ্যে দেবীকে রাখা হয়। আর বাইরে রাখা হয়েছে অষ্টধাতুর দক্ষিণাকালী মূর্তি। এই কালীমূর্তিই মা কল্যাণেশ্বরী রূপে পূজিত হন।
মন্দির তৈরির পরেও একটি গল্প প্রচলিত রয়েছে। জনশ্রুতি অনুযায়ী, একবার নাকি এক শাঁখারি সারা দিন চারিদিকে ঘোরার পরেও শাঁখা বিক্রি করতে না পেরে দেবীর মন্দিরে এসে দুঃখপ্রকাশ করছিলেন। জনশ্রুতি, তাঁর দুঃখ দেখে দেবী বালিকা রূপে তার কাছে এসে দুই হাতে শাঁখা পরে নেন। তিনি ওই শাঁখারিকে জানান, সবনপুর গ্রামে তাঁর বাবার কাছে গিয়ে শাঁখার পয়সা নিয়ে নিতে। এই কথা শুনে দেবীর বলে দেওয়া সবনপুর গ্রামনিবাসী ওই ব্যক্তির কাছে গিয়ে পৌঁছন শাঁখারি। তাঁর কাছে সব ঘটনা শুনে সেই ভদ্রলোক চমকে যান। তিনি বলেন, আমার তো কোনও কন্যা সন্তান নেই। তা হলে আমার নাম করে কে শাঁখা পরল? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে তিনি শাঁখারির সঙ্গে মন্দিরের দিকে রওনা হন। মন্দিরের সামনে গিয়ে ওই ব্যক্তি বলে ওঠেন, কোথায় আমার মেয়ে আমি দেখতে পাচ্ছি না। শাঁখারি বলে ওঠেন, কোথায় গেলে মা তুমি। একবার দেখা দাও।
প্রচলিত লোকগাঁথা অনুসারে, তাঁদের ডাকে সাড়া দিয়ে দেবী কল্যাণেশ্বরী কন্যারূপে পাথরের চূড়ায় পিছন ঘুরে বসে শাঁখা পরা হাত দুটি তুলে দেখিয়ে দেন। সেই থেকে আজও পূজিত হচ্ছেন মা।