একবার দেবী পার্বতী রুষ্ট হয়েছিলেন মহাদেবের ওপর। মহাদেব নাকি মর্ত্যে এসে এক কুচনী মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন। মহাদেব মর্ত্যে চাষ-বাস শেখাতে এসেছিলেন। এসে গ্রামের এক কুচনী মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। সেই সম্পর্ক থেকে এক সন্তানও হয় তাঁর। মহাদেব সেই নারী ও সন্তানকে কিছুতেই ছেড়ে যেতে চাইছিলেন না। শেষে নারদকে নিয়ে দেবী পার্বতী স্বর্গ থেকে মর্ত্যে আসেন। মহাদেবের প্রতি রাগে তিনি ওই গ্রামের অনেক ধানের গোলা নষ্ট করে দিচ্ছিলেন। গ্রামে খাবারের অভাব দেখা দেয়। ভগবান শিব বুঝতে পেরেছিলেন দেবীর রাগের কারণ আসলে তিনি। দেবীর রাগ না পড়লে গ্রামটাকে বাঁচানো যাবে না। দেবী পার্বতী মহাদেবকে শর্ত দিয়েছিলেন যে একমাত্র মহাদেব স্বর্গে ফিরলেই দেবী তাঁর রাগ কমাবেন। মহাদেব পার্বতীর অনুরোধে কুচনী মেয়েকে ছেড়ে কৈলাসে ফিরে যান। বল্লুকানগরীর কুচনী মেয়েকে ছেড়ে মহাদেব কৈলাসে ফিরলেন কিন্তু দেবী পার্বতীর মন তাতেও গলেনি। মহাদেব রেবতী কুচনীর ছোঁয়ায় অপবিত্র হয়েছেন , তাই কিছুতেই অপবিত্র স্বামীকে তিনি গ্রহণ করতেন নারাজ। পার্বতী মহাদেবকে আদেশ দিলেন, "আগে মুক্তি হ্রদে স্নান করে শুদ্ধ হয়ে এসো তারপর আমি তোমার চরণ বন্দনা করব।"
তিনি দেবী পার্বতীকে সন্তুষ্ট করতে মুক্তি হ্রদে শুদ্ধ হতে গিয়েছিলেন। সেখানে দুটো হাঁসের জলকেলী দেখে পদ্মপাতার ওপর মহাদেবের বীর্য পতন হয়। সেই বীর্য পেটে যায় এক নাগিনীর। এই নাগিনীর গর্ভে জন্ম নেন দেবী মনসা। সাপেদের তরফে বিধান দেওয়া হয় যে পাঁচটা সাপ দিয়ে মহাদেবের অবৈধ সন্তান মনসাকে পদ্মবনে রেখে আসতে। পদ্মবনে রেখে আসা হয় ছোট্ট মনসাকে। সেখানেই ভগবান শিব দেখতে পান দেবী মনসাকে। শিব জানতে পারেন মনসার আসল পরিচয়। নিজের মেয়েকে চিনতে পারেন। এদিকে বাবা-মেয়ের এই মিলনের কথা জানতে পারেন দেবী পার্বতী।
পার্বতীর মাথায় তখন আগুন রাগ। কারো কথা তাঁর কানে ঢুকলো না। কালীমন্দিরে ঢুকে ফুলের সাজিতে মনসাকে দেখতে পেয়ে মনসাকে মারধর করা শুরু করেন। মারের চোটে মনসার এক চোখ অন্ধ হয়ে যায়। পরে দেবী পার্বতী নিজের ভুল বুঝতে পেরে মনসার পুজো প্রচলনের জন্য ভগবান শিবকে রাজি করিয়েছিলেন।
উত্তরবঙ্গের রাভা জনগোষ্ঠীর মানুষদের মধ্যে মা মনসার এই মর্ত্যে পুজো পাওয়া নিয়ে আরেকটি লোককাহিনী প্রচলিত আছে। দেবী পার্বতী মনসার মর্ত্যে পুজো হওয়া ভালোভাবে মেনে নেননি। পার্বতী নিজের ভেতর আরেকটি রাগী রূপ তৈরি করলেন। সেই রুপ হল মা ঠাকুরানী। মনসার প্রভাব পৃথিবীতে কমিয়ে দেওয়ার জন্য পার্বতী মা ঠাকুরানীকে পৃথিবীতে পাঠান। যেখানেই মা মনসার পুজো হতো সেখানে মা ঠাকুরানী নানা রোগের সৃষ্টি করতে লাগলেন। মানুষ গবাদি পশু কেউ রেহাই পাননি মা ঠাকুরানীর রাগ থেকে। এভাবে ধীরে ধীরে মা মনসার প্রভাবের থেকেও পৃথিবীতে প্রকট হয়ে ওঠে মা ঠাকুরানীর প্রভাব। রোগে শোকে নাজেহাল মানুষ তখন মুক্তি পেতে দেবী মনসাকে ভুলে মা ঠাকুরানীর পুজোয় মেতে ওঠেন। উত্তরবঙ্গে শুরু হয় মা ঠাকুরানীর পুজো।
উত্তরবঙ্গের কোচবিহার জেলার রসিকবিলের টাকোয়ামারির পাগলীকুঠি, ব্রজের কুঠি, আলিপুরদুয়ার জেলার মধ্য কামাখ্যাগুড়িতে রাভা সম্প্রদায়ের মধ্যে এখনো মা ঠাকুরানীর পূজোর প্রচলন রয়েছে। লোকশ্রুতি অনুযায়ী কোন বাড়ির উপর মা ঠাকুরানীর নজর লাগলে চোখ ওঠা, বসন্ত, ঘা-পাঁচড়া জাতীয় চর্ম রোগ হয়।
মা ঠাকুরানীর পুজো বাড়ির ভেতর হয় না। বাড়ির বাইরে খোলা আকাশের নীচে সাধারণত রাস্তার তিন মাথার মোড়ে দেবীর পুজো হয়। মা ঠাকুরানীর পূজোয় কোন মূর্তি লাগে না। আলাদা মন্ত্র নেই। চর্ম রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি পুজোর উপকরণ সমস্ত কিছু নিয়ে দিনের বেলা একটা তিন মাথার মোড়ে চলে যায়। ধুপ, কলা, পাতার আগার দিক আর এক বালতি নিমপাতা মেশানো গরম জল এবং দুধ কলা চিনি নিয়ে ঠাকুরের উদ্দেশে পুজো দেন। সঙ্গে দেন একটা পিঁড়ি।
পুজোর সমস্ত উপকরণ সাজিয়ে মা ঠাকুরানীর উদ্দেশে প্রণাম করে আক্রান্ত ব্যক্তি পিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে মা ঠাকুরানীর নাম নিয়ে মাথায় জল ঢালেন। তারপর সব উপকরণ ওখানে রেখে বাড়ি ফিরে আসতে হয় সেই আক্রান্ত ব্যক্তিকে। কথিত আছে পুজোর উপকরণ কেউ ছুঁলে কিংবা ঐ জলে কেউ পা দিলে সেই ব্যক্তির উপরও নাকি মা ঠাকুরানীর প্রকোপ পড়ে।
বাড়ির গাই গরুর উপর মা ঠাকুরানীর নজর লাগলে ওরা খাওয়া-দাওয়া করতে চায় না, হাঁটাচলা করতে পারেনা, শরীরে ঘা পেঁচড়া দেখা দেয়। তখন সেই আক্রান্ত গরুকেও মা ঠাকুরানীর উদ্দেশে পুজো দেওয়া প্রসাদ সমর্পন করা হয়। পুজোর শেষে গোবর, কলাপাতাসমেত কুলো গরুটার সামনে রেখে গরুটাকে প্রণাম করতে হয়। তারপর কুলো সমেত সমস্ত কিছু রাস্তায় ফেলে রেখে পেছনদিকে না তাকিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়। শোনা যায় এভাবেই নাকি বাড়ির গাই গরু মা ঠাকুরানীর প্রকোপ থেকে মুক্তি পায়। এভাবেই মা ঠাকুরানী উত্তরবঙ্গের মানুষের যন্ত্রণার কষ্টের দেবতা হয়ে উঠেছেন।