বাংলার বাঙালিরা দীর্ঘকাল যাবৎ শক্তির উপাসনা করে আসছে। বঙ্গের প্রতিটি প্রান্তে লুকিয়ে রয়েছে কোন না কোন প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী কালী পুজোর ইতিহাস। মেদিনীপুরের খেপুতে সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের পুজো তার মধ্যে অন্যতম।
কলকাতার অন্যতম বনেদি পরিবার এই সাবর্ণ রায়চৌধুরীরা, বাংলা জুড়ে প্রায় আটটি কালী মন্দিরের সঙ্গে এই পরিবারের ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে। একদা মেদিনীপুরের খেপুত এলাকার জমিদার ছিলেন বর্ধমানের মহারাজ।
বর্ধমানের রাজপরিবারের সঙ্গে বড়িশার জায়গীরদার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের সুসম্পর্ক বজায় ছিল। রামদুলাল রায় চৌধুরী বর্ধমানের রাজপরিবারের রাজা তেজশ্চন্দ্র মতান্তরে তেজচাঁদার খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সে সময় মেদিনীপুরের চেতুয়া ও বরদা পরগনা রাজা তেজচাঁদের জমিদারির অধীনে ছিল। ওই দুই পরগনায় রাজস্ব আদায়ে নিয়ে প্রায়শই সমস্যা দেখা দিত। রাজস্ব আদায় না হলে কি রাজপাঠ চলে! রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত সমস্যায় বিচলিত হয়ে তেজচাঁদ খেপুত এলাকার জন্য ছোট জমিদারের খোঁজ করতে শুরু করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত বড়িশার রামদুলাল রায় চৌধুরীর পূর্বের সুসম্পর্কের কথা মনে করে তাঁকেই ওই অঞ্চলের জমিদারি প্রদান করেন রাজা তেজচাঁদ। তবে মনে করা হয়, এই জমিদারি প্রাপ্তির বিষয়ে খুব সম্ভবত রামদুলালের জ্যাঠামশাই সন্তোষ রায় চৌধুরী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের সন্তান
রামদুলাল রায় চৌধুরী ১৭৭২ সালে অধুনা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার চেতুয়া অঞ্চলের জমিদারি লাভ করেন। এরপরেই তিনি রূপনারায়ণ নদের পশ্চিম তীরে খেপুত উত্তরবাড় গ্রামে চলে আসেন। পরবর্তীতে তিনি রূপনারায়ণ নদের তীরেই খেপুত
উত্তরবাড় গ্রামে নিজের বাসস্থান স্থাপন করেন। একই সঙ্গে নির্মাণ করেন মাটির ঠাকুরঘর। প্রায় ২৫০ বছরের সেই ইতিহাস আজও অক্ষত! তদানিন্তন সময়ে এই এলাকার হুজুরি জমিদার ছিলেন বর্ধমানের মহারাজরা।
ওই মাটির ঠাকুর ঘরেই প্রতিষ্ঠা হয় দেবী খেপতেশ্বরীর, আজও সেখানে বিরাজ করেছেন দেবী কালিকা। দেবী এখানে খেপতেশ্বরীর নামেই পরিচিত, মায়ের মূর্তিটি খুবই প্রাচীন। জানা যায়, ১৭৯৮ সালে কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে রামদুলাল
তাঁর খেপুতের বাড়িতে কালীপুজো শুরু করেন। রায়চৌধুরীদের সঙ্গে দেবী কালিকার সম্পর্ক খুবই নিবিড়। কালীঘাটের দেবী কালিকা হলেন এই বংশের আরাধ্যা দেবী। কালীঘাটের কালীর অনুকরণেই খেপতেশ্বরী দেবীর নাসিকায় রসকলি, বৈষ্ণবী তিলক।
দীঘল নয়না দেবীর গলায় ঝুলছে নরমুণ্ডমালা। মায়ের সঙ্গে রঘুনাথ জিউকেও তাঁরা খেপুতের বাড়িতে নিয়ে যান। উত্তরবাড়ের প্রাচীন বিগ্রহ শ্রীশ্রীমা খেপতেশ্বরী অষ্টভুজা মহিষমর্দিনী। দেবী চতুর্হস্তা ভদ্রকালীরূপ। ভীষণা মূর্তির মধ্যেই স্নেহময়ী বরদাতৃ মাতৃরূপ। দেবীর বামে শৃগাল ও ডাকিনী আর দক্ষিণে যোগিনী। আগে দেবীর জন্য একটি মাটির মন্দির ছিল। পরে ১৭৭৯ সাল নাগাদ সম্ভবত বর্ধমানরাজের আনুকূল্যে মাটির মন্দিরের জায়গায় তৈরি হয় দক্ষিণমুখী আটচালা মন্দির। মন্দিরের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ যথাক্রমে ২৪ ফুট ১০ইঞ্চি এবং ২৩ ফুট ৬ইঞ্চি।
প্রাচীন রীতি রেওয়াজ মেনেই বংশানুক্রমিকভাবে ছুতোর, নাপিত, কামার, মালাকার, গয়লা সকলে আজও এই বাড়ির পুজোয় যোগ দেন। সাবর্ণদের কালীপুজোর সঙ্গে গোড়া থেকে যে সব সূত্রধর, নরসুন্দর, কর্মকার, কুম্ভকার, মালাকার ও গো-পালক
পরিবার জড়িত ছিলেন, তাঁরা বংশানুক্রমিক ভাবে আজও এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। সূত্রধর ও কুম্ভকারেরা আজও সাবর্ণদের ঠাকুর মূর্তি তৈরি করার পরে অন্য কালীঠাকুর তৈরিতে হাত দেন। প্রাচীন করাল বদনা কালী সেজে ওঠেন ডাকের
সাজে। ডাকের গয়নায় সজ্জিত এই প্রাচীন করালবদনা কালী আজও খেপুতসহ গোটা মেদিনীপুর অঞ্চলের মানুষের কাছে জনপ্রিয়। সাবর্ণদের প্রায় সোয়া দুশো বছরের পুরোনো এই কালীপুজোর ব্যয়ভার মূলত বহন করে সাবর্ণ রায়চৌধুরী
পরিবার। এই বাড়ির অধীনস্থ ইশারা পুকুরের মাছ দিয়েই দেবীকে ভোগ দেওয়া হয়। মানতের জন্য প্রচুর সংখ্যায় বলিদানও হয় এই পুজোয়। এই বাড়ির দেবী কালিকার গায়ের রঙ সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে তৈরি করা হয়। মৃৎশিল্পী আজও প্রথমে সাবর্ণদের ঠাকুর তৈরি করেন তারপর অন্য কালী ঠাকুর তৈরি করতে শুরু করেন। খেপুত-উত্তরবাড়ের বাড়িতে কালীপুজো শুরু হওয়ার পর চেতুয়া পরগণার অধীন রাধাকান্তপুর, সাগরপুর, কৈজুড়ি-মুগড়িয়া প্রভৃতি মৌজারও জমিদারি পান
রামদুলাল রায় চৌধুরী।
বড়িশা বাড়ির দুর্গাপুজোর বিজয়াদশমীর দিন রামদুলাল আমিষ ভোগ দিয়ে দেবীর তৃণমূর্তির পদে মৃত্তিকা লেপন করেছিলেন। তারপর এখানে পুজো শুরু হয়েছিল। সেই রীতি আজও মানা হয়, অর্থাৎ বড়িশাবাড়ির দুর্গাপুজোর শেষে খেপুতবাড়ির
কালীপুজো শুরু হয়। বিজয়াদশমীর দিন বিশেষ নিয়মে পুকুর থেকে মাটি তোলা হয়। পরের দিন থেকেই কালীপ্রতিমা তৈরির কাজ আরম্ভ হয়। নিয়ম মেনে পারিবারিক আটচালায় তৈরি হয় প্রতিমা।
এই বাড়ির পুজোয় বিশেষ কিছু নিয়মরীতি রয়েছে। মহিলারা কালী পুজোয় কেবল ভোগ রান্নাতেই অংশ নিতে পারেন। বাড়ির একটি পুকুরের মাছ দিয়েই দেবীকে ভোগ নিবেদন করা হয়। পুজোর যাবতীয় কাজ করেন বাড়ির পুরুষ সদস্যরা। মানতের
জন্য প্রচুর ছাগবলিও হয় এই পুজোয়। আগে বলির সেই সংখ্যাটি শতাধিক হলেও, বর্তমানে তা ১৫-২০-তে এসে নেমেছে। বলিদানের সময়ে ঢাক-ঢোল-কাঁসরের আওয়াজে পাড়া মুখরিত হয়। দীপাবলীতে বাড়ির মেয়েরা বাজি প্রদর্শনীতে মেতে ওঠেন।
এই প্রাচীন প্রতিটি রীতিনীতি মেনেই আজও পুজো হয়। যেমন ঘট তোলার আগে প্রথমে মাটির হাঁড়িতে জল ভর্তি করা হয়। সেই হাঁড়ি রাখা হয় আটচালাতেই। জলের হাঁড়িতে প্রদীপ ভাসিয়ে দেওয়া হয়। প্রদীপে ছোট ছোট ছিদ্র রাখা হয়। ওই ছিদ্র দিয়ে এক সময় জল-ঢুকে প্রদীপ পূর্ণ হলে তা ডুবে যায়। জলের হাঁড়িতে চন্দনের টিপ দেওয়া থাকে। এক একটি টিপ ২৪ মিনিটের সূচক। প্রদীপ ডোবা মাত্রই পরিবারের একজন পুকুরে ঘট ডুবিয়ে দেন, আর সঙ্গে সঙ্গে পুজো শুরু হয়।
দেবী কালিকাকে আমিষ ভোগ দেওয়া হয়, ভোগে সব রকম সবজি দেওয়া হয়। মা কালীর ভোগে অন্নভোগ, খিচুড়িভোগ, ডাল, ভাজা, পায়েস, নানা রকমের তরকারি ইত্যাদি নিবেদন করা হয়। মহাকালের জন্য আতপচালের নিরামিষ ভোগ হয়। এই রায়চৌধুরী বাড়িতে কালীপুজোয় বাড়ির মহিলারাই ভোগ রান্না করেন।
সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারে শাক্ত, শৈব এবং বৈষ্ণব; এই তিন ধারার মেলবন্ধন ঘটেছে। খেপুতের বাড়িও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে এখানে একটি মন্দিরেরই শাক্ত-শৈব-বৈষ্ণবধারার সমন্বয় ঘটেছে। এখানকার শ্যামরায়ের পরিবর্তে শ্রীরঘুনাথ আর তাঁরই মন্দিরে শিব ও শ্যামার যুগল বিগ্রহ বিরাজমান। দীপাবলীর দিন কালীমাতার উদ্দেশ্যে ভোগ নিবেদনের আগে শ্রীরঘুনাথের ভোগ নিবেদন করা হয়।
কালীঘাটের রীতি রেওয়াজ মতো রামদুলাল দীপান্বিতা কালীপুজোর দিন কুলো বাজিয়ে চালগুঁড়ি আর গোবরের তৈরি অলক্ষ্মী মূর্তি বিদায় করে লক্ষ্মীপুজোর রীতিও প্রচলন করেছিলেন। তবে এই লক্ষ্মীপুজো দেবালয়ে না করে গৃহকোণে অনুষ্ঠিত
হয়। কালীঘাটের নিয়ম মেনে লক্ষ্মীর নিরামিষ ভোগে উচ্ছে,করলা বা তেঁতোজাতীয় কোন সবজি দেওয়া নিষেধ।
ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে অক্ষত রেখে প্রাচীন রীতি মেনে আড়াইশো বছর ধরে মেদিনীপুরের খেপুত গ্রামে খেপতেশ্বরীর পুজো হয়ে আসছে।