হৈমন্তী শুক্লা ও একটি ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই

এইচএমভি স্টুডিওয় গান রেকর্ডিং হচ্ছে। 'আমার বলার কিছু ছিল না'। গাইছেন, হৈমন্তী শুক্লা। যন্ত্রশিল্পীরা সঙ্গত করলেন। সঙ্গত শেষ হতেই শুরু করলেন ফিসফাসও। তাতে বক্তব্য উঠে এল : এটা গান হল, না কাঁদুনি গাওয়া হল কিছুই যেন তাঁরা বুঝতে পারলেন না! তাও আবার পুজোর গান! রেকর্ড নির্ঘাত ডুববে!


কানাঘুষো তাঁদের কথা হৈমন্তীর কানেও উঠল। স্বাভাবিকভাবেই শুনে মন বেশ খারাপ হল। এ-গান ব্যর্থ হলে তাঁর আর ঘুরে দাঁড়ানোর যে কোন উপায় থাকবে না! তবে তার সঙ্গে এও মনে হল যে, জীবনের প্রথম রেকর্ডটি সম্বন্ধেও লোকে বলেছিল নাকিকান্নার গান। তবুও সেই 'এ তো কান্না নয় আমার' গানটি লোকের চিত্তহরণ করে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিল। এ-গানের ক্ষেত্রে কি তেমনটা ঘটবে না? যাক গে, গেয়েছি তো প্রাণ ঢেলে। সবটুকু দরদ দিয়ে। যা হবার হবে।


হ্যাঁ, যা হওয়ার তাই-ই হল। রেকর্ড বেরুতেই ঘটল এক কাণ্ড। গানটির সুর, কথা আর মর্ম মোচড়ানো আবেদন শ্রোতার প্রাণের পরে তুফান তুলল। ঘরে ঘরে মণ্ডপে মণ্ডপে 'আমার বলার কিছু ছিল না' মুখরিত হল। গানটি শুধু সে-বছরের সেরা হয়েই রইল না, চিরদিনের সেরা গানগুলোর অন্যতম হয়ে রইল।


তবে এই সাফল্যের পিছনেও একটু ব্যর্থতার ইতিহাস আছে।


হৈমন্তীর পিতা হরিহর শুক্লাকে বাংলার সঙ্গীত জগতের মানুষ চেনেন না, এমন কেউ ছিলেন না। তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পণ্ডিত মানুষ। মেয়েকে নিজের হাতে তালিম দিয়ে মানুষ করেছেন। তাঁর যত্নেই হৈমন্তীর কণ্ঠ কঠিন-সহজ-আবেদনময়ী সবরকম গানের জন্যই প্রস্তুত হয়ে উঠেছিল।


এমন যে হৈমন্তী, তিনি সাতের দশকের শুরুতে প্রথম রেকর্ড করলেন, তা জনপ্রিয়তার শিখর ছুঁলো। সেটা হিন্দুস্থান রেকর্ড থেকে বেরিয়েছিল। জনপ্রিয়তার এই পর্বেই এইচএমভির ডাকে তিনি হিন্দুস্থান ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। আর তারপরই এল ব্যর্থতার পালা।


সেই ব্যর্থতায় হৈমন্তীর গায়ন বা কণ্ঠের কোন দোষ ছিল না। রেকর্ড জনপ্রিয় হতে গেলে যে ধরণের গানের প্রয়োজন হয়, রেকর্ড করার এই পর্বে সেই ধরণের গানের নির্বাচন হল না। ফলে, কয়েকটা রেকর্ড হল বটে, কিন্তু একটাও জনপ্রিয় হল না। কাজেই হৈমন্তী এইচএমভির বাতিল শিল্পী তালিকার মধ্যে পড়ে গেলেন। হৈমন্তী এবার প্রমাদ গণলেন। তিনি না-পারছেন হিন্দুস্থানে ফিরতে, না পারছেন এইচএমভিতে নিজের জায়গা বজায় রাখতে!


হৈমন্তীর প্রথম রেকর্ডের পেছনে গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান অনেকখানি। কারণ, হিন্দুস্থান রেকর্ডের সঙ্গে তিনিই যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন। টালমাটালের এই দিনে হৈমন্তীর এই সহৃদয় মানুষটির কথাই মনে পড়ল। তিনি পুলকবাবুর শরণ নিলেন।


সদাশয় মানুষ পুলকবাবুর মধ্যস্থতায় এইচএমভি শেষমেশ একটি এলপি রেকর্ডে অনেকের মাঝে হৈমন্তীর দুটি গান রাখতে রাজি হলেন। এইচএমভি রাজি হতেই পুলক হৈমন্তীকে সোজা পাঠিয়ে দিলেন মান্না দে'র কাছে। মান্না দে সে-বছর পুজোয় রেকর্ড করবেন বলে একটি গানে অসাধারণ সুর দিয়ে রেখেছিলেন, আর পুলক লিখেছিলেন সেই গানের অনন্য-সাধারণ কথা।


সেই গানটিই পুলক হৈমন্তীকে দিয়ে দিতে রাজি করাতে গেলেন। তাতে প্রথমটায় নিমরাজি হয়ে মান্না গানটি শেষমেশ হৈমন্তীকে গাইতে বললেন। হৈমন্তী গানটি এমন দরদ দিয়ে গাইলেন যে, মান্নার হৃদয় সঙ্গে সঙ্গে জিতে নিলেন। মান্না উদার খুশি হয়ে বললেন, যাও গানটি তোমায় দিয়ে দিলাম...


মান্নার স্বার্থত্যাগ আর হৈমন্তীর গায়ন দুই মিলে ইতিহাস তৈরি করল, হৈমন্তীর ডুবন্ত কেরিয়ারকে সবেগে বাঁচিয়ে দিল। হৈমন্তী আজ যে বাংলা গানের জগতে জীবন্ত কিংবদন্তি, তার মূলে তাঁর সাধনা, নিষ্ঠা, সহৃদয়তা যেমন আছে, তেমনি আছে মান্না বা পুলকের মতো হৃদয়বান মানুষের অবদানও। সে অবদানের কথা হৈমন্তী প্রায় প্রতিটি আলাপচারিতাতেই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। সত্তর পেরোনো এই সঙ্গীতশিল্পীর কণ্ঠ আজও আমাদের আপ্লুত করে চলেছে, মুগ্ধ করে চলেছে; আজ হৈমন্তীর জন্মদিনে প্রার্থনা করি, এমনি করেই তিনি আমাদের ঋদ্ধ করে চলুন আরও বহু বহু কাল...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...