সন ১৯৬৯। পৃথিবীর ইতিহাসে এক ওলোটপালটের বছর। খুব তাড়াতাড়ি বদলে যাচ্ছিল চেনা দুনিয়ার ছবি। শহর কলকাতাও সেই বদলের বাইরে নয়। বদল এসেছিল আর একজনের জীবনেও। সিনেমার জগতে এক দশক পার করে ফেলেছেন ততদিনে, এবার নতুনভাবে ভাঙতে চাইছিলেন জীবনকে। অন্যরকম চোখে দেখতে চাইছিলেন নিজেকে।
অভিনয় কেরিয়ার শুরু করেছিলেন সত্যজিতের ছবি দিয়ে। তপন সিনহা, মৃণাল সেনের সঙ্গেও কাজ করে ফেলেছেন। কিন্তু মূল ধারার বাণিজ্যিক ছবির স্রোত থেকে তখনও খানিকটা দূরে। বাণিজ্যিক না অন্যধারার লড়াইতে তাঁর গায়ে ‘অন্য ধারার’ ছাপ। এই টাইপকাস্ট হয়ে যাওয়া থেকেই বেরতে চাইছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। মনেপ্রাণে।
প্রথম ছবি ১৯৫৯-এ। তারপর কেটে গিয়েছে দশ বছর। করে ফেলেছেন ৩৮ টি ছবি। সত্যজিতের আধ ডজন ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা গিয়েছে। মৃণাল সেনের সঙ্গে ৩টি। তপন সিনহার একজোড়া ছবিতে। অজয় কর, অসিত সেন আরও অনেকের সঙ্গে কাজ করে ফেলেছেন এক দশকে।
মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙালির আড্ডা থেকে আলোচনায় জায়গা করে নিয়েছেন। বিশেষ করে বাম মনোভাবাপন্ন বৌদ্ধিক চর্চায় অভ্যস্থ নব্য বাঙালির তিনি নতুন আকর্ষণ। দর্শকদের কাছে ম্যাটিনি আইডল উত্তমকুমারের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ হিসেবে উচ্চারিত হচ্ছে তাঁর নাম। উত্তম কুমারের সঙ্গে করে ফেলেছেন দু’দুখানা ছবি। তপন সিনহার পরিচালনায় ঝিন্দের বন্দী আর সলিল দত্তর অপরিচিত।
কিন্তু তবুও যেন অনেকটা বাকি। এমন সন্ধিক্ষণে তাঁর হাতে এল এক অন্যরকম ছবির চিত্রনাট্য। এ এক নতুন চ্যালেঞ্জ। ছক ভেঙে একেবারে ঘরে ঘরে। হয়ে উঠলেন বাঙালির ‘সৌমিত্তির’। ছবির নাম ‘তিন ভুবনের পারে’। সমরেশ বসুর কাহিনি। পরিচালনায় আশুতোষ বন্দোপাধ্যায়।
ষাটের দশকের কলকাতা ছবির পটভূমি। এই শহরেরই প্রেম-অপ্রেমের গল্প। ছবির পাত্রপাত্রী সুবীর আর সরসী। সুবীরের ভূমিকায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সরসী তনুজা।
ষাটের শেষে দেশ জুড়ে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল তা ছড়িয়ে পড়েছিল সমাজের সব স্তরে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতেও লেগেছিল ধাক্কা। তার সরাসরি প্রভাব পড়েছিল যুব সমাজের ওপর। সুবীর সেই সমাজেরই প্রতিনিধি। নিজেকে আপাদমস্তক ভেঙ্গেছিলেন সৌমিত্র। দর্শকরা পর্দায় পেয়েছিল একেবারে অন্য এক সৌমিত্রকে।
‘তিন ভুবনের পারে’- নিয়ে কথা বলতে গিয়ে জানিয়েছিলেন, " চরিত্রটি ছিল বাস্তব থেকে অনুপ্রাণিত। তখনকার সময় আমাদের সবার জানাশোনার মধ্যেই এমন দু একজন ছিল, যারা একটু খাপছাড়া, অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়। আর আমি তাদের স্টাইল, অঙ্গভঙ্গী অনুকরণের চেষ্টাই করেছিলাম চরিত্রটা ফুটিয়ে তুলতে।” ছবিতে গানের দায়িত্বে ছিলেন সুধীন দাশগুপ্ত ও মান্না দে।
'হয়ত তোমারই জন্যে...' আর ‘কে তুমি নন্দিনী’ প্রেমে পড়া বাঙালির ‘সিগনেচার টিউন’ হয়ে যায় চিরকালের জন্য। ছবি শুরুও হয় একটি গান দিয়ে। পাড়ার ছেলেরা ফুটবল ম্যাচ জিতেছে। তাই হইহই করে গান গেয়ে তাদের বিজয় উল্লাস… জীবনে কী প্রাব না…”। এই গানই যেন গোটা ছবির মূল সুরটিকে বেঁধে দেয়। সরসীর প্রবেশও এই গানের মাঝেই…সেই গান মূহুর্তে বদলে যায়…কে তুমি নন্দিনী… হয়ে।
‘তিন ভুবনের পারে’ ছবির সুবীর হয়ে ওঠা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্য খুব সহজ ছিল না। এই ছবির আগে যে সমস্ত ছবিতে তিনি অভিনয় করেছিলেন তার থেকে এ ছবির চরিত্র একেবারে আলাদা। এতদিন পর্যন্ত পর্দায় বাঙালি উত্তম-সুচিত্রা রোম্যান্স দেখতে অভ্যস্থ ছিল। এই ছবি যেন বদলে দিল সেই দেখার চোখ।
পাশ্চাত্য নাচের প্রশিক্ষক বব দাসের কাছে বলরুম ডান্স শিখেছিলেন সৌমিত্র। সেই সময় বাংলা ছবিতে আলাদা করে ডান্স ডিরেক্টর বা ফাইট ডিরেক্টর রাখার চল আসেনি।
'তিন ভুবনের পারে' ছবিতে সৌমিত্রের ছক ভাঙা অভিনয় দেখে সে সময় সিনেমা সমালোচকরাও চমকে গিয়েছিলেন। সমালোচনায় লেখা হয়েছিল, "সৌমিত্র যেন সত্যজিতের হাতে গড়া অতুলনীয় সৃষ্টি।" এই ছবিতে যেভাবে তিনি নিজেকে ভেঙে ছিলেন তা একজন দক্ষ অভিনেতার পক্ষেই সম্ভব।
সমরেশ বসু সুবীর চরিত্রকে গড়েছিলেন তাঁর দেখা কোনও চেনা চরিত্রের আদলে। ছবির মন্টুর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়নি কখনও। সৌমিত্র তাঁর নিজের দেখা দিয়েই রক্তমাংসের করেছিলেন ছবির চরিত্রকে। সেই সুবীরের সঙ্গেই একটানে বাঁধা পড়েছিল বাঙালি। সে বাঁধন আজও আলগা হয়নি এতটুকু…