অসম্ভব এক পাথুরে রাস্তা। স্বাভাবিকভাবে চলার কোন উপায়ই নেই। অ-স্বাভাবিকতাই সঙ্গী। কিন্তু তাঁর থেমে থাকার উপায় নেই। তাঁকে শিখর ডাকছে। সঙ্গে রয়েছেন আরও এক পাহাড়-প্রেমী। অনেক চেষ্টা। অবশেষে দুজনেই পৌঁছলেন সেই স্বপ্ন-পুরীতে। স্বপ্নপুরীর নাম মাউন্ট এভারেস্ট। সময়টা সকাল সাড়ে এগারোটার আশেপাশে। ১৯৫৩ সালের ২৯মে। মাউন্ট এভারেস্টে পৌঁছেছিলেন শেরপা তেনজিং নোরগে এবং এডমন্ড হিলারি।
১৯১৪ সালের মে মাসে তিব্বতে জন্ম তেনজিং নোরগের। শিখরের টানেই নেপালে এসেছিলেন। আর্থিক অক্ষমতা, সামাজিক বাধা তাঁর জীবনের নিত্যসঙ্গী ছিল। তবুও পাহাড় ছিলো নেশার মত। ঊনিশ বছর বয়সে দার্জিলিং এসেছিলেন। পাহাড়ের সঙ্গে প্রেম ছোট থেকেই। ১৯৩৫ সালে প্রথম অভিযান করেছিলেন পাহাড়ে। শুরুতে পাহাড়ী অভিযাত্রীদের সঙ্গে কুলি হিসেবে যেতেন। তাঁদের জিনিসপত্র, খাবার-দাবার বয়ে নিয়ে যেতেন। সঙ্গে বইতেন স্বপ্ন। পাহাড় ছোঁয়ার স্বপ্ন। এরিক শিপ্টন নামে একজন অভিযাত্রীকে সঙ্গ দিয়েছিলেন প্রথমবার। সেটা ছিল এভারেস্ট অভিযান। কিন্তু নিজে পৌঁছাননি এভারেস্টে সেবার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শেরপা হিসেবে অনেকগুলো অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি। ১৯৫২ সালে দুজন অভিযাত্রীর সঙ্গে প্রথমবার এভারেস্ট ছোঁয়ার চেষ্টা করেন শেরপা হিসেবে। কিন্তু অসফল হয়েছিলেন।
এভারেস্টের দক্ষিণের এই প্রান্ত বড় কঠিন। ১৯৫৩ সালে এডমন্ড হিলারির অভিযাত্রী দলের সঙ্গে এই কঠিন পাথুরে পথেই যাত্রা শুরু করেছিলেন তেনজিং নোরগে।এভারেস্টের ৮৫০০ মিটার দক্ষিনে তাঁবু ফেলেছিলেন অভিযাত্রী দল। এরপরের পথ কিছুতেই অতিক্রম করা যাচ্ছিল না। অবশেষে এডমন্ড হিলারির সাহায্যে সেই পথে যাত্রা করেন তাঁরা। তাই ওই বিশেষ পথ আজও ‘হিলারি স্টেপস’ নামে পরিচিত।
অনেক ঝড়, বাধা পেরিয়ে অবশেষে তেনজিং নোরগে এবং এডমন্ড হিলারি পৌঁছেছিলেন নিজের স্বপ্নপুরীতে। ছুঁয়ে দেখেছিলেন সাদা বরফের ওই মায়া জগতকে। আত্মজীবনী 'ম্যান অফ এভারেস্ট'-এ তেনজিং নোরগে বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর অভিযানের। প্রথমবার এভারেস্টে পৌঁছে ১৫ মিনিট সময় কাটিয়েছিলেন এই পাহাড় প্রেমী। পুদিনার তৈরি একটা বিশেষ পিঠে যা সাধারণত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে প্রসাদের সমান তাই খেয়েছিলেন এভারেস্টের চূড়ায় দাঁড়িয়ে। ঈশ্বরকে ছোঁয়ার মতো করেই তেনজিং নোরগে স্পর্শ করেছিলেন এই উচ্চতম পর্বত শৃঙ্গকে।
ভারতবর্ষ, নেপাল এবং ব্রিটিশ সরকারের তরফ থেকেও তাঁকে বিশেষ পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়েছিল এই এভারেস্ট অভিযানের জন্য। নিজের শেষ জীবনটা পাহাড়ের কোলে কাটিয়েছিলেন। দার্জিলিঙে থাকতেন। এই পাহাড়-পুত্র পাহাড়ের কোলে মাথা রেখে অনন্তের পথে পাড়ি দিয়েছিলেন ৭১ বছর বয়সে।