পর্বত-মানুষ দশরথ মাঝির কাহিনী

বিহারের গয়া অঞ্চলের এক পাহাড়ি সকাল। সাল্টা ১৯৫৯।

 পাহাড়ের গায়ে রোদ আর আকাশ সবে রঙের গল্প লেখা শুরু করেছে। বছর তিরিশের এক কৃষক তাঁর বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে কাজে ব্যস্ত। বাড়িতে স্ত্রী ফাল্গুনী অপেক্ষায়।

 সদ্য বিয়ে করা স্ত্রীর টানে দুপুরের খাবার খেতে বাড়িতে যাওয়াই পছন্দ করতেন ওই কৃষক। সেদিন বাড়ি ফিরে দেখলেন স্ত্রী বাড়ীতে নেই। ভাবলেন ছদ্ম-অভিমানে স্ত্রীর সঙ্গে খুনসুটি করবেন। কিন্তু কোথায় কি!

সময় পেরিয়ে যাচ্ছে অথচ ওই স্ত্রীর দেখা নেই। সাধারণত পাহাড়ি অঞ্চলে প্রয়োজনীয় জল বা খাবার নিয়ে আসতে অনেকটা দূরেই যেতে হয়। ওই কৃষক ভেবেছিলেন, তেমনই কোন কারণে বোধহয় তাঁর স্ত্রী দূরে কোথাও গেছেন। অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পর কৃষকের প্রতীক্ষায় বাঁধ ভাঙ্গলো।

খুঁজতে বেরোলেন তাঁর স্ত্রীকে। পাহাড়ি অমসৃণ রাস্তায় বেশ অসুবিধা হচ্ছিল খুঁজতে।

কিছুটা এগোনোর পরই আবিষ্কার করলেন এক রক্তাক্ত দেহ। সেই শরীরে প্রাণ আছে কি না তা পরখ করে দেখার মত সাহস ছিল না তাঁর।

 নিজের স্ত্রীর দেহ অমসৃণ পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন সেই কৃষক। দশরথ মাঝি। হাসপাতাল ছিল প্রায় পঞ্চান্ন কিলোমিটার দূরে।

তাই হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার আগেই অনুভব করছিলেন নিজের স্ত্রীর রক্তাক্ত শরীরটা আসলে একটি মৃতদেহ। সম্ভবত কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে আসতে বেরিয়েছিলেন দশরথের স্ত্রী।

সরু পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় পড়ে যান। মৃত্যু হয় তাঁর। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পরিষেবার দূরত্ব অতিক্রম করার মত সময় ছিল না গ্রাম্য পাহাড়ি ওই কৃষক-পত্নীর।

গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু হল না।

mountain-1

 বিহারের গয়া জেলার ওই কৃষক দশরথ মাঝির একমাত্র আপনজন বলতে ছিল তাঁর স্ত্রী। স্ত্রীকে হারিয়ে স্বভাবতই জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কথা ছিল হয়ত তাঁর। কিন্তু হলো উল্টো।

শেষের থেকেই শুরুর গল্প লিখলেন দশরথ মাঝি। দ্যা মাউন্টেন ম্যান অর্থাৎ পর্বত-মানুষ। তাঁর জীবন উপন্যাস বা গল্প বা চিত্রনাট্যের থেকে কোন অংশে কম নয়।

স্ত্রীকে হারিয়ে দশরথ মাঝি বুঝতে পারলেন বিপদসংকুল পাহাড়ি রাস্তা যে কোনো মানুষের মৃত্য-দূত হয়ে উঠতে পারে। পাহাড়ে প্রয়োজনীয় জিনিসের পরিষেবা খুব সহজলভ্য নয়। সেই পরিষেবা পরিবর্তনের সম্ভাবনাও বেশ কঠিন এবং সময়-সাপেক্ষ। এমনকি পরিষেবা পরিবর্তনের জন্য সরকার বা প্রশাসনের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে। কে বলতে পারে, তার মধ্যেই আরো কোন দশরথ তাঁর ফাল্গুনীকে হারাবে না !

 তাই পরিবর্তনের ভার তিনি তুলে নিলেন নিজের হাতে। রাস্তা তৈরি  শুরু করলেন। সঙ্গী একটি হাতুড়ি আর কাস্তে। প্রথম জীবনে ধানবাদের কয়লা খনিতে কাজ করতেন দশরথ। শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। পরে তিনি বিহারের গয়ার গেহলুর গ্রামে ফিরে আসেন এবং কৃষিকাজ শুরু করেন।

 ধানবাদে কাজ করার সময়ই শিখে নিয়েছিলেন খোদাই করার কাজ। সেই দক্ষতাকে কাজে লাগিয়েই ২২ বছর ধরে পরিশ্রম করে খোদাই করেছিলেন একটি রাস্তা। দূরত্ব ১১০ মিটার।

নিজের জমানো টাকা-পয়সাও ব্যয় করেছিলেন রাস্তা খোদাইয়ের কাজে।

১১০ মিটার লম্বা, প্রায় সাড়ে সাত মিটার গভীর এবং ৯ মিটার চওড়া এই রাস্তা তাঁর গ্রাম থেকে হাসপাতালের দূরত্বকে ৫৫ থেকে কমিয়ে ১৫ কিলোমিটারে নিয়ে এসেছিল। বিহারের গয়া জেলার মূল দুটি ব্লকের মধ্যে দূরত্ব কমে গিয়েছিল এই রাস্তাটি তৈরি হওয়ার পরে। ফলে যাতায়াত এবং অন্যান্য কাজ সহজ হয়ে যায়।

প্রথমদিকে গ্রামের মানুষরা দশরথের এই উদ্যোগকে ‘পাগলামি’ বলে উড়িয়ে দিয়েছিল। এমনকি যখন প্রথমবার হাতুড়ি দিয়ে দশরথ মাঝি রাস্তা তৈরির জন্য পাহাড়ের গায়ে আঘাত করা শুরু করেছিলেন, অনেকেই তাঁর এই পাগলামিকে অলৌকিক কোন বিষয় বলে রীতিমতো ভয় পেয়েছিল। তবে পরে অনেকেই তাঁকে সাহায্য করেছিল। এমনকি রাস্তা তৈরির প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও কিনে দিয়েছিল।

১৯৬০ সাল থেকে রাস্তা তৈরি শুরু করে দশরথ মাঝি তা শেষ করেন ১৯৮২ সালে।

 এক সাদা চুলের জাদু-বুড়ো পাহাড়ের গায়ে রাস্তা তৈরি করেছিলেন ২২ বছর ধরে। তিনি কাজ শেষ করে দিল্লি সরকারের কাছে আবেদন করেছিলেন স্বীকৃতির জন্য। তাঁর কাজ পরে সামাজিক এবং প্রশাসনিক স্বীকৃতিও পায়। অনেক তথ্যচিত্র ও সিনেমাও তৈরি হয়েছে তাঁকে নিয়ে।

mountain-2

আপনজনকে হারিয়ে একটা পাহাড়ি মানুষ জীবনের গল্প লেখা শুরু করেছিলেন। পাহাড়ের মতোই দৃঢ় ছিল তাঁর সংকল্প। নিজের আত্মবিশ্বাস ও সাহসকে পাথেয় করেই এগিয়েছিলেন দশরথ মাঝি। প্রকৃতি, জীবন সবকিছুতে পাহাড়ের ভূমিকা এমনই। দৃপ্ত, কঠিন, সারল্যে ভরা, যাকে প্রত্যাখ্যান করা যায় না। ২০০৭ সালে গলব্লাডারের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান এই প্রত্যয়ী পাহাড়ি জাদু-মানুষটি।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...