গল্প মনে হলেও সত্যি! বাস্তবে খোঁজ পাওয়া গেল সমুদ্র লোকের মৎস্যকন্যাদের।জনি ডেপ অভিনীত পাইরেটস অফ্ দ্য ক্যারিবিয়ন, অজানা ঢেউয়ের স্রোতে। স্বয়ং নায়ক জলদস্যুর ভূমিকায়। সকলে বেরিয়েছেন সমুদ্রে। উদ্যেশ্য ফাউন্টেন অফ ইউথ এর সন্ধান।যৌবনের অমৃত। একটা দৃশ্যে কিছু মৎস্য কন্যারা ঘিরে ফেলেন যাত্রীদের। তাদের চোখে লালসা। জীবনের।
আর সেই ফাঁদেই পা দিল যাত্রীরা। পলকেই শেষ হল জীবন আর যৌবন। মনে পড়ে যায় ঠাকুরমার ঝুলির প্রসঙ্গও। সেই রূপকথার মৎস্যকন্যাদেরই খোঁজ পাওয়া গেল একটু দ্বীপে। তবে গল্পের মত এরা কারও জীবন নেননা; বরং ফিরিয়ে দেন।লম্বা খোলা চুল, অনাবৃত শরীর, চোখে যেন অজানা পৃথিবীর রহস্য। এই চেনা ছক ভেঙে বাস্তবের মৎস্য কন্যারা শেক্সপিয়রের কবিতার সেই কালো রমণী। কাল্পনিক ঘেরাটোপের বহু দূরে এদের অবস্থান। চামড়া গুটিয়ে এসেছে। বলিরেখারা বয়সের প্রমান দিচ্ছে। অথচ সমুদ্রের ঢেউয়ের বাঁকে বাঁকেই তাদের জীবন ধারণ।
আল সু রা। সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে প্রবীণা মৎস্য কন্যা। বয়স ৯৫ বছর। দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু দ্বীপ। রয়েছেন তারা। শরীরের অর্ধেক অংশ রূপকথার সেই মাছের মতো নয়।হেনিয়ো বা সাগরকন্যা নামেই পরিচিত।
হেনিয়োরা অগভীর সমুদ্রে ডুব দিয়ে ঝিনুক আর শঙ্খ সংগ্রহ করে। ঝিনুক আর শঙ্খ রপ্তানি করে যে অর্থ উপার্যিত হয়, মূলত তা দিয়েই চলে হেনিয়োদের সংসার। এই দ্বীপে পুরুষরাও বসবাস করেন। মহিলারা যে সব ঝিনুক ও শঙ্খ সংগ্রহ করেন, সেগুলিকে চাহিদা অনুযায়ী বাজারে পৌঁছে দেন এই দ্বীপের পুরুষরা। হেনিয়োরা আসলে ডুবুরি ।
বয়স ৬০ বছরের বেশি। এত বয়স হওয়া সত্ত্বেও এঁরা সমুদ্রের অন্তত ২০ মিটার গভীরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটান রুজির টানে। তবে সঙ্গে থাকে না কোনও অক্সিজেন সিলিন্ডার। দীর্ঘদিনের অভ্যাসে এঁরা জলের গভীরে ২ মিনিটেরও বেশি সময় দম বন্ধ করে থাকতে পারেন। এ ভাবেই দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা সমুদ্রের প্রায় ৬৬ ফুট গভীরে ঝিনুক আর শঙ্খের খোঁজে কাটান হেনিয়োরা।
অপেক্ষা করতে হয় ঝিনুক বা শঙ্খর প্রজননের সময় পর্যন্ত। ফলে যুগ যুগ ধরে ঝিনুক আর শঙ্খের যোগান আর সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্র প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। বর্তমানে হেনিয়োদের মতে, সমুদ্রের স্রোত এই অঞ্চলে অনেকটাই বেশি। তাছাড়া সমুদ্রের তলও পাথুরে, রুক্ষ। একই সঙ্গে পরিবেশও হঠাত্ হঠাত্ অনেকটাই বদলে যায়। তাই এই কাজে প্রাণের ঝুঁকিও রয়েছে যথেষ্ট! ২০১৭ সালেও একজন হেনিয়োর মৃত্যু হয়েছে প্রতিকূল আবহাওয়ার জন্য।
যদিও নতুন প্রজন্মের বেশিরভাগই কষ্টসাধ্য এবং ঝুঁকিপূর্ণ এই পেশার সঙ্গে যুক্ত থাকতে চান না। অনেকেই বিকল্প পেশা বেছে নিচ্ছেন। তাই বিগত ৫০-৬০ বছরে হেনিয়োদের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে কমেছে। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৬০ সালে যেখানে হেনিয়োদের সংখ্যা ছিল প্রায় ২৬ হাজার বর্তমানে তা কমে হয়েছে মাত্র ৪,৫০০।
জেজুতে ডাইভিংয়ের ঐতিহ্য প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ৪৩৪ থেকে মেলে। মূলত ডাইভিং শুধুমাত্র পুরুষদের পেশা থাকলেও হাতেগোণা কিছু নারী তখন তাদের স্বামীদের সাথে এই পেশায় যুক্ত হয়। ঐতিহাসিক মতে, ১৭’শ শতকের আগে কোনোও নারী ডুবুরির অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। ওই শতকের জেজু দ্বীপের ভূগোল নিয়ে রচিত একটা রচনায় প্রথম এই কথা বর্ণনা করা হয়। এতে জামনিয়ো শব্দের উল্লেখ আছে যার অর্থ ডাইভিং করে এমন নারী ।
ছোটবেলায় শোনা রূপকথার গল্পগুলোর মধ্যে মৎস্যকন্যার গল্প অন্যতম। মৎস্যকন্যা শব্দটি শুনলেই কল্পনায় চলে আসে সমুদ্রের রহস্যময়ী কোনও এক সুন্দরী রমনীর চেহারা। তবে সে দেখতে অন্যান্য রমনীর মত নয়। তার মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত মানুষ এবং কোমরের নিচের অংশ দেখতে মাছের মত।
জেজু দ্বীপের এই মৎস্যকন্যাদের দেখতে রূপকথার মৎস্যকন্যাদের মত নয়। তারা সাধারণ নারী। সংসার চালান। সেই দায়েই সমুদ্রের নিচে থাকা।সাধারণ ডুবুরিরা জলের নিচে অনেক সময় থাকার জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহার করে। কিন্তু রূপকথার মৎস্যকন্যারা কোনও অক্সিজেন ছাড়াই থাকতে পারে। আর হেনিয়োরাও অক্সিজেন ব্যবহার না করায় এদের মৎস্যকন্যা বলাটা নিছক মজা করা হবেনা।এই লড়াকু নারীদের সাহস অনুপ্রেরণাযোগ্য। এই ভাবেই রূপকথার কিংবদন্তীরা বাস্তবের উদাহরণ হয়ে উঠুক।