যোধপুর থেকে প্রায় ৪০ মাইল দূরে উত্তর-পূর্বে মেড়তা নামের এক রাজ্যে রতন সিংহ নামে এক জায়গীরদার ছিলেন। এই রতন সিংহের একমাত্র কন্যা ছিলেন মীরাবাঈ। শৈশবেই মীরা মাতৃহীনা হন। মাতামহীর কাছে লালন-পালন হয়েছিল তাঁর। তবে মীরার শিক্ষা-দীক্ষার অনেকটাই পাওয়া তাঁর পিতামহের কাছ থেকে। তবে মীরার পিতামহ দুদাজী নাতনিকে শুধু আদরই দেননি, পড়াশোনা শিখিয়েছিলেন এবং নিজের আত্মার দৃঢ়তার বলে বলিয়ান হতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। মীরা জীবনে যে দোঁহা বা গানগুলি রচনা করেছেন তা একদিকে যেমন তার কৃষ্ণের প্রতি ভালোবাসার অংশ তেমনি পিতামহের থেকে পাওয়া শিক্ষাও তাকে এই পথে নিয়ে যেতে অনেকখানি সাহায্য করেছিল।
সঙ্গে গিরিধর-গোপালের একটি মূর্তি। মূর্তি নিয়ে যিনি সর্বদা মোহিত হয়ে থাকেন তাঁর রূপটিও শান্ত, সমাহিত যেন কোন নীরব নদীর স্রোত। তিনি মীরাবাঈ।
সারা জীবন এই মূর্তিটিকে নিজের আরাধ্য দেবতা, ভালোবাসার মানুষ সবকিছু হিসেবে মেনে এসেছিলেন মীরাবাঈ। শিশু মীরা এবং এই মূর্তি নিয়ে একাধিক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। একটি কাহিনী মতে শৈশবে একবার এক বিয়ের শোভাযাত্রা দেখে মেয়েরা নাকি তার মাথামহীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে "আমার বর কোথায়", তার মাথামহী তখন কৃষ্ণ ঠাকুরের জন্য মালা গাঁথছিলেন। তাই অবুঝ, ছোট্ট নাতনির প্রশ্নের উত্তর দিতে তিনি কৃষ্ণকেই দেখিয়ে দেন মীরার বর হিসেবে। ইতিহাস বলে এখান থেকেই মীরার মনে কৃষ্ণের প্রতি প্রেম তৈরি হয়।
অন্য কাহিনী মতে, মীরাদের বাড়িতে শ্রীকৃষ্ণের মূর্তিসমেত একবার এক অতিথি সাধু এসেছিলেন। যথারীতি মীরা তখন বালিকা। ছোট্ট মেয়েটা ওই কৃষ্ণের মূর্তিটি পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। এদিকে সাধু তাঁর নিজের মূর্তিটি দিতে নারাজ। তবে ছোট্ট মেয়ের কান্না আর সহ্য করতে পারছিলেন না সাধুবাবা। তিনি এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে মীরাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যান। তবে মীরা ওই মূর্তির কথা ভুলতে পারেননি।
একদিন এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে। ওই সাধু এসে মীরার হাতে মূর্তিটি দিয়ে যান। সাধু জানান তিনি কৃষ্ণের স্বপ্নাদেশ পেয়ে তাঁর নিজের কৃষ্ণের মূর্তিটি নিজেকে দিতে এসেছেন। তখন থেকেই নাকি ছোট্ট মীরার প্রিয়তম ও আরাধ্য হয়ে ওঠেন গিরিধরগোপালের সেই মূর্তি, যাকে আঁকড়ে ধরে মীরা বাকি জীবনটা কাটিয়েছিলেন।
পড়াশোনা আর কৃষ্ণের প্রতি আরাধনা ও ভালবাসা এই নিয়েই কিশোর থেকে যুবতীর বয়সের দিকে এগিয়ে চলেছিলেন মীরা। এদিকে তাঁর পিতামহ মারা যান। মীরার এক জ্যেঠতুতো দাদার ওপর তার তত্ত্বাবধানের ভার পড়ে। কৃষ্ণের প্রতি ভালোবাসা ও পিতামহের থেকে পাওয়া শিক্ষাকে পাথেয় করে মীরা তখন থেকেই গান রচনা শুরু করছিলেন। তাঁর কন্ঠে তাঁর রচিত গান আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ছিল চারিদিকে।
কিন্তু দাদা মীরার এই ভক্তি ভালোভাবে নেননি। বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় মীরার। মীরার স্বামী ছিলেন রাণা কুম্ভের পৌত্র সংগ্রাম সিং-এর জ্যেষ্ঠ পুত্র ভোজরাজ। ভোজরাজ সঙ্গে মীরার বিয়ে হয় ১৫১৬ সালে। শ্বশুরালয়ে যাওয়ার সময় মীরা মেড়তা থেকে গিরিরাজের মূর্তিটা চিতোরে নিয়ে চলে যান।
সেখানেও তিনি তাঁর আরাধ্য দেবতা কৃষ্ণের আরাধনার মাধ্যমে জীবন কাটাতেন। তবে দাম্পত্য সুখ মীরা বেশিদিন ভোগ করতে পারেন নি। অল্প বয়সেই মীরা স্বামীহারা হন।
স্বামী মারা যাওয়ার পর অল্প সময়ের মধ্যেই মেয়েরা নিজের বাবাকেও হারান। এত অল্প সময়ের ব্যবধানে প্রিয়জনের মৃত্যু মীরার অন্তরে গভীর রেখাপাত করেছিল। শুধু তাই নয়, সংসার জীবন থেকে মীরা ধীরে ধীরে নিজেকে সরিয়ে নিতে থাকেন। চিতোরে সন্ন্যাসিনীর জীবন-যাপন শুরু করেছিলেন মীরা।
এদিকে রাণা সংগ্রাম সিংহের মৃত্যুর পর মীরার যে দুই দেওর পরপর চিতোরে রাণা হন, তাঁদের মধ্যে দ্বিতীয় দেওর বিক্রমজিৎ মীরার ধর্মচর্চার বিরোধী ছিলেন।
সারাদিন মীরার কৃষ্ণের প্রতি এমন আরাধনা রীতিমতো চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল রাণা বিক্রমজিতের। অত্যাচার শুরু হয় মীরার ওপর। কথিত আছে , মীরাকে বিষ দিয়ে হত্যারও চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সেই বিষের কোন প্রতিক্রিয়ায় হয়নি মীরার ওপর। ইতিহাস বলে স্বয়ং ভগবান কৃষ্ণের আশীর্বাদ ছিল মীরার উপর। মীরার আরেক দেওর যখন রাণা হন, তিনি মীরাকে আবার ধর্মচর্চা করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন।
কিন্তু এই কৃষ্ণ-সাধিকা, সন্ন্যাসিনী তখন সংসার জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের আরাধনাতে মগ্ন হয়ে রয়েছেন। নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সাধনার কাছে সমর্পণ করেছিলেন এই সাধিকা। মীরার মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল তার উত্তর ইতিহাসে পাওয়া যায় না। তবে এই সাধিকা যে মৃত্যুহীন, অমর তা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়।