সে এক কালের কথা। যে কালে শহর কলকাতাতেও অন্তঃপুরচারিণীদের বাইরে যাবার রীতি ছিল না। পুজোপার্বণ অথবা পারিবারিক আচার-অনুষ্ঠানে আত্মীয়গৃহে অথবা গঙ্গাস্নানে যেতে হলে মেয়েদের জন্য বরাদ্দ ছিল কাপড়ের ঘেরাটোপ লাগানো পালকি। কাপড়ের রং বলে দিত তা কোন বাড়ির পালকি। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ঘেরাটোপ হত হলুদ পাড়ের উজ্জ্বল লাল রঙের।
সেই সময়ে, সেই পরিবেশে এক আশ্চর্য অগ্নিশিখা জ্বলে উঠেছিল জোড়াসাঁকোয়। তিনি দিগম্বরী দেবী। ১৮০৯ সাল নাগাদ যশোরের নরেন্দ্রপুর গ্রামের রামতনু রায়চৌধুরীর শিশু কন্যা দিগম্বরীর সঙ্গে দ্বারকানাথের বিয়ে হয়। তিনি অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন। তাঁর মুখের আদলে জোড়াসাঁকো বাড়ির জগদ্ধাত্রী প্রতিমার মুখ গড়া হত বলে শোনা যায়। দিগম্বরী দেবীর নাতবৌ জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর লেখায় আছে, “আমার দিদিশাশুড়িও খুব সুন্দরী ছিলেন শুনেছি। তাঁকেও নাকি মনুবুড়ি বলে এক পুরনো দাসী পছন্দ করে এনেছিল”। সেকালে পিরালি পরিবারে এমনই ছিল প্রথা। জোড়াসাঁকো ঠাকুরপরিবার তখন গোঁড়া বৈষ্ণব। মাছ, মাংস, রসুন, পেঁয়াজ ঢুকত না বাড়িতে। গৃহদেবতা লক্ষ্মীজনার্দনের নিত্যপূজা নিজের হাতে করতেন দ্বারকানাথ। তখনও তিনি ‘প্রিন্স’ হন নি।
ব্যবসায়ে উন্নতি পাল্টে দিল দ্বারকানাথের শুদ্ধাচারী জীবনযাপন। দিগম্বরীর জীবনে কিন্তু কোনো পরিবর্তন আসেনি। তিনি সূর্য ওঠার আগে পুজোয় বসতেন, জপতেন লক্ষ হরিনামের মালা, পাঠ করতেন ভাগবত ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থ। দয়া বৈষ্ণবী এসে শোনাত নানান ধর্মকথা। স্বপাক আহার করতেন দিগম্বরী। ওদিকে বেলগাছিয়ার বাগানবাড়িতে এমন খানাপিনা, মদ্য-মাংস সহ আমোদপ্রমোদ শুরু হল যে তা নিয়ে শোরগোল পড়ে গেল শহর জুড়ে। সংবাদপত্রে লেখালেখি, রূপচাঁদ পক্ষীর গান – বাদ রইল না কিছুই।
দেরিতে হলেও বাইরের কথা পৌঁছত অন্দরমহলেও। বেলগাছিয়া বাড়ির স্ফূর্তির কথায় দিগম্বরী প্রথমে বিশেষ আলোড়িত হন নি। কিন্তু যখন সারা কলকাতায় সেই হুল্লোড় নিয়ে আলোচনা শুরু হল তখন শোনা কথা যাচাই করার জন্য কয়েকজন সঙ্গীনী সহ পৌঁছে গেলেন সেখানে। তখনকার দিনের এক গৃহবধূর পক্ষে যা ছিল অভাবনীয়। এরপরের ঘটনা আরও বৈপ্লবিক। দ্বারকানাথের উদ্দাম জীবনযাপন দেখে মর্মাহত দিগম্বরী ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের কাছে জানতে চাইলেন তাঁর কী করণীয়। পণ্ডিতরা বিধান দিলেন, স্বামীকে ভক্তি ও সেবা করলেও সহবাস নয়। সরে এলেন দিগম্বরী। শুধু প্রতিদিন দ্বারকানাথের শয্যার কাছে মাটিতে প্রণাম করতেন তিনি। কোনো প্রয়োজনে দ্বারকানাথের সঙ্গে কথা বলতে হলেও সাত ঘড়া গঙ্গাজলে নিজেকে শুদ্ধ করতেন তিনি।
এই অত্যাচার নিতে পারল না তাঁর শরীর। কয়েক দিনের জ্বরে ১৮৩৯ সালের ২১ জানুয়ারি মৃত্যু হল দিগম্বরী দেবীর। অগ্নিশিখা নিভে গেল। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিতে ধরা আছে সেদিনের ছবি, “আমি তো তাঁহার মৃত্যুর সময়ে মনে করিতে পারি নাই যে তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে”। আর দ্বারকানাথ? দিগম্বরীর প্রয়াণের কিছু পরে টেগোর কোম্পানির একটি জাহাজ সমুদ্রে ডুবে গেলে ব্যথিত দ্বারকানাথ বলেছিলেন, “লক্ষ্মী চলিয়া গিয়াছেন, অলক্ষ্মীকে এখন আটকাইবে কে”?