বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার পথিকৃৎ সত্যেন্দ্রনাথ বসু

ঊনিশ শতকের কথা। এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিতে বসেছেন এক ছাত্র। বিজ্ঞানের এই ছাত্রের সাহিত্য ক্ষেত্রেও পারদর্শী। সেই সময় আই.এস.সি ক্লাসের এন্ট্রান্স পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বেশ কড়া হত। সে বছর পার্শিভালে নামে এক ইংরেজির অধ্যাপক খাতা দেখছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের।

বিজ্ঞানের সেই ছাত্রের ইংরেজি সাহিত্যের প্রগাঢ় জ্ঞান মুগ্ধ করেছিল অধ্যাপককে। সেই ছাত্রের খাতায় তিনি অতিরিক্ত দশ নম্বর দিয়েছিলেন। নম্বর তো দিলেই হল না, প্রয়োজন সঠিক যুক্তির। খাতার নিচে ইংরেজি অধ্যাপক পার্শিভালে লিখে দিলেন দু’লাইন। '' এই ছেলেটি অসাধারণ, এর কিছু বলার আছে।"

অসাধারণ এই ছাত্রের পাণ্ডিত্য সমৃদ্ধ করেছিল বিজ্ঞানকে, এই দেশকেও। সত্যেন্দ্রনাথ বসু। ১৮৯৪ সালের পয়লা জানুয়ারি জন্ম। বাবা সুরেন্দ্রনাথ বসু, মা আমোদিনী বসু। পৈতৃক বাড়ী চব্বিশ পরগণা জেলার বড় জাগুলিয়া গ্রামে, তবে কলকাতাতে মূলত বাস করতেন তাঁরা। ছোট থেকেই মেধাবী ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। পড়াশোনার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভা। ১৯০৯ সালে পঞ্চম স্থানসহ এন্ট্রান্স এবং কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯১১ সালে প্রথম স্থান অধিকার করে আই.এ.এস পরীক্ষা পাস করেন তিনি।

১৯১৫ সালে মিশ্র গণিত-এর প্রথম শ্রেণীতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। ১৯১৫ সালে কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ তখন প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ডক্টর মেঘনাথ সাহার সাহচর্যে সত্যেন্দ্রনাথ বসু গবেষণায় মনোনিবেশ করলেন এখানে। ‌১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি সেখানে রিডার হিসেবে যোগদান করেন। প্রায় চব্বিশ বছর নিষ্ঠা ও ভালোবাসার সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন সেখানে।

১৯২৪ সালে তাঁর 'প্লাঙ্কস ল অ্যন্ড দি লাইট কোয়ান্টাম হাইপোথিসিস' নামের প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় যেটি আলবার্ট আইনস্টাইন পড়ে আশ্চর্য হয়ে যান। আইনস্টাইন তখন ওই প্রবন্ধের তথ্য জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন। সঙ্গে যোগ করেন প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা। এই প্রকাশিত প্রবন্ধটি বিজ্ঞান জগতে ‘আইনস্টাইন তত্ত্ব‘ নামে পরিচিত হয়। 'বোসন কণা'র জন্ম হয়। ১৯২৯ সালে অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস-এর পদার্থ বিজ্ঞান শাখার সভাপতি এবং ১৯৪৪ সালে মূল সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন।

১৯৪৫ সালে তিনি পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো শুরু করেন। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন খয়রা অধ্যাপক হিসেবে এবং স্নাতকোত্তর বিজ্ঞান বিভাগের ডিন হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৫৮ সালে তিনি লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। রাজ্যসভায় মনোনীত সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন। পন্ডিত এই মানুষটি বারবার অনুভব করেছেন বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা কোথাও যেন বঞ্চিত। তাই বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার বিষয়ে তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন।

এই লক্ষ্যে কলকাতায় ‘বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই পরিষদের মুখপত্র 'জ্ঞান ও বিজ্ঞান' প্রকাশ করেন। মাসিক পত্রিকা এটি। এই বিজ্ঞানীকে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ 'দেশিকোত্তম' পুরস্কারে ভূষিত করেন। ভারত সরকারের 'পদ্মভূষণ' পুরস্কারও পেয়েছিলেন তিনি।

পুরস্কার, পাণ্ডিত্য, প্রগাঢ় ও জ্ঞান সবকিছুর বাইরেও এক খেয়ালী মানুষ ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। ডুবে থাকতে ভালবাসতেন নিজের কাজে। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। একবার মেয়ে বায়না ধরল সিনেমা দেখতে যাওয়ার। এদিকে মেয়ের বাবা তখন গণিতের এক জটিল সমস্যার সমাধানে মগ্ন। কিন্তু মেয়ের আব্দার উপেক্ষা করার উপায় নেই। মেয়েকে নিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে চলে গেলেন সিনেমা হলে। গাড়ি থেকে নেমে গাড়োয়ানকে টাকা দিতে গিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ বসু দেখলেন সঙ্গে নেই মানিব্যাগ। ভুলোমনা মানুষটির তখন মনে পড়ল নিশ্চয়ই বাড়িতে ফেলে এসেছেন টাকার ব্যাগ।

অগত্যা আবার ফিরে যেতে হল বাড়িতে। টেবিলেই পড়েছিল সেই মানিব্যাগ। আর মানিব্যাগের পাশে পড়েছিল সেই অংকের সমাধানের খাতাটা। হঠাৎ করেই মাথায় এসে গেল সেই অংকের সমাধান এর কথা। ব্যাস মেতে উঠলেন তাতে। এদিকে মেয়ে যে অপেক্ষা করছে সিনেমা হলে সে কথা‌ আর কে মনে রাখে। অগত্যা গাড়ির চালক সেদিন মনে করিয়ে দিলেন মেয়ের কথা। তখন কাঁচুমাচু মুখ করে চল্লেন মেয়েকে আনতে।

অসম্ভব ভালো এসরাজ বাজাতে পারতেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তাঁর ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। পরিচয় ছিল দিকপাল বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে। প্রেমের গল্প লিখেছিলেন পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে। সাহিত্য, সংগীত বিজ্ঞান সবটাই তাঁর কাছে ছিল সাধনার মত। বুঁদ হয়ে থাকতেন এইসব চর্চায়। দেশের স্বাধীনতার লড়াই-এ পাশে থেকেছেন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের। অনুশীলন সমিতির সঙ্গে ছিল প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। আত্মভোলা এই মানুষটি ১৯৭৪ সালে পৃথিবী ত্যাগ করেছিলেন। নোবেল পুরস্কার থেকে বঞ্চিত এই বিজ্ঞানীর কীর্তি আজও উজ্জ্বল।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...