কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজ। ওই কলেজের স্বনামধন্য অংকের অধ্যাপক জি.এইচ.হার্ডির কাছে একটি চিঠি এল। সময়টা ১৯১৩ সাল। চিঠি এসেছে সুদূর ভারতবর্ষ থেকে। লিখেছেন একজন ২৩ বছর বয়সী যুবক। ছেলেটি চেন্নাই পোর্ট ট্রাস্টে অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে কর্মরত। প্রথাগত স্কুলের শিক্ষা তাঁর নেই। কিন্তু সংখ্যাতত্ত্ব তাঁর নেশা। এমনকি বেশ কিছু জটিল গাণিতিক সমীকরণের কথাও উল্লেখ ছিল ওই চিঠিতে।
ছেলেটি ট্রিনিটি কলেজের ওই অধ্যাপকের করা একটি বিশেষ গাণিতিক সূত্রের বিরোধিতা করেছিল। হার্ডি অবাক। এমনভাবেও কেউ চিঠি লিখতে পারে। গণিতের ক্ষেত্রে জি.এইচ.হার্ডি স্বনামধন্য ছিলেন সেই সময়ে। তাঁর কাজকে চ্যালেঞ্জ করছে একজন কেরানি, যে কিনা সামান্য এক সরকারি দপ্তরে কর্মরত! অবাক হলেও ছেলেটির গণিতের প্রতি এই ভালোবাসা হার্ডির মনে প্রভাব ফেলেছিল। তিনি ছেলেটিকে আমন্ত্রণ জানালেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার জন্য। এমনই এক অংক-প্রেমী মানুষ ছিলেন শ্রীনিবাস রামানুজন।
১৮৮৭ সালের ২২শে ডিসেম্বর চেন্নাইতে জন্ম শ্রীনিবাস রামানুজনের। পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিলেন। স্কুলের প্রথম দিকে সমস্ত বিষয়েই মোটামুটি ভাল ফল করতেন। কিন্তু সময় যত এগোলো, রামানুজন অনুভব করলেন, অন্য বিষয়গুলোয় যেন আগ্রহ পাচ্ছেন না। একমাত্র অংকের বইটা খুললেই অন্য জগতে পৌঁছে যেতেন তিনি। একই অংক নানাভাবে সমাধান করা তাঁর কাছে ম্যাজিকেরই মতো। গণিতের সূত্র, সমীকরণ সব যেন তার কাছে জাদু-বাস্তবের ছোঁয়া। ফলে অন্য বিষয়গুলো ব্রাত্য হয়েই রইল তাঁর কাছে।
তাই স্কুলের পরীক্ষায় বরাবর অংকের নম্বর ছিল আকাশছোঁয়া। কিন্তু বাকি বেশিরভাগ বিষয়েই পাশ নম্বরটুকুও তুলতে ব্যর্থ হতেন। প্রথম দিকে বেশ কয়েকটা স্কুল বদল করেছিলেন। কিন্তু ফল সেই একই। অঙ্কে তাঁর ধারেকাছে কেউ আসতে পারত না। কিন্তু বাকি বিষয়ে একেবারে ব্যর্থ। যথারীতি পড়াশোনায় ইতি পড়ল।
বাবা-মা ভাবলেন এ ছেলের নিশ্চয়ই কোনো ব্যামো আছে। না হলে সারা দিন অংকের বইখাতা নিয়ে বসে থাকে। তাই ছেলের বিয়ে দিয়ে দিলেন। দায়িত্ব পড়লে অসুখ নিশ্চয়ই সেরে যাবে। চেন্নাই পোর্ট ট্রাস্টের দপ্তরে কাজ করা শুরু করলেন অ্যাকাউন্টেন্ট হিসেবে। এদিকে অংকের অসুখ তখন সুখে পরিণত হয়েছে ছেলেটির কাছে। তাই চিঠি লিখেছিলেন হার্ডিকে। কিন্তু হার্ডির আমন্ত্রণেও সেই সময় ট্রিনিটি কলেজে যেতে পারেননি। তখনকার সময়ে চেন্নাইয়ের ব্রাহ্মণ পরিবারের সদস্যদের বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু বাধ্যবাধকতা ছিল। সেই বন্ধন অস্বীকার করে তিনি যেতে পারেননি প্রথমে।
এদিকে অ্যাকাউন্টেন্টের কাজ করতে তাঁর মোটেই ভাল লাগে না। বাড়ি এসেই অঙ্কের খাতা খুলে বসে যান। বুঁদ হয়ে থাকেন তাতে। নাওয়া খাওয়া ভুলে সারাক্ষণ অংক কষে যান।
রামানুজনের বন্ধুরা তাঁকে সাহায্য করলেন গণিতের বিষয়ে জীবন পথে এগিয়ে যেতে। দুজন ব্রিটিশ গণিতবিদকে তিনি চিঠি লিখেছিলেন। রামানুজন অংকের এক নতুন সূত্র খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন সেই সূত্র প্রকাশ করতে। সেই বিষয় উল্লেখ করা ছিল চিঠিতে। কিন্তু তাঁরা পত্রপাঠ রামানুজনের সাহায্যের দাবি ফেরত পাঠালেন।
শ্রীনিবাস শুধু চাইতেন তাঁর গাণিতিক সমীকরণ যেন পৃথিবীর সকল মানুষের কাছে পৌঁছয়। ঠিক যেমন একজন শিল্পী তাঁর শিল্পকর্মকে মানুষের কাছে পৌছে দিতে চান।
অংকের প্রতি রামানুজনের গভীর প্রজ্ঞা এবং ভালোবাসা জি.এইচ.হার্ডিকে প্রভাবিত করেছিল। তাঁর সাহায্যে চেন্নাই প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান শ্রীনিবাস রামানুজন। শুরু হয় তাঁর পথ চলা। সেখানে অংকের গবেষণা করা শুরু করেন।
তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। অংক যেনো তাঁর আত্মার সঙ্গে জুড়ে গেল। তিনি যেমন অংকের গভীরে পৌঁছে তার ভিতর থেকে মণিমাণিক্য খুঁজে বের করলেন, গনিতও তাঁকে জীবনের অন্য পথ দেখাল।
যে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিন প্রাচীনপন্থী পরিবারের কারণে যেতে পারেননি, পরে সেখান থেকেই ডাক এসেছিল তাঁর। গবেষণা করার জন্য। ছাত্র হিসেবে গিয়েছিলেন সেখানে। পরিবারের বিরোধিতা সত্ত্বেও সেখানে গিয়েছিলেন।
ওখানে গিয়ে দেখা পান আর এক বিশ্ববরেণ্য গণিতবিদের। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ। সব রকম বিরোধিতা এবং বাধা সত্বেও গণিতের পথ কোনদিন ছাড়েননি শ্রীনিবাস রামানুজন। তাঁর নিষ্ঠা, জ্ঞান এবং ইচ্ছাকে সম্মান জানানোর জন্য ২০১২ সাল থেকে তাঁর জন্মদিন অর্থাৎ ২২শে ডিসেম্বর দিনটি জাতীয় অংক দিবস হিসেবে পালিত হওয়া শুরু হয়।
১৯২০ সালের ২৬শে এপ্রিল এই গণিত-সাধকের মৃত্যু হয় তাঁর। তবে তাঁর সৃষ্টি, কাজ আজও অনেক শিক্ষার্থীর জীবন-দর্শক।