১৯০৮ সাল। অত্যাচারী কিংসফোর্ডকে হত্যার চেষ্টার অপরাধে বহু বিপ্লবীকে জেলে বন্দী করা হয়েছিল। স্বাধীনতা আন্দোলনের আগুনে ফুঁসছে বাংলা তখন। বন্দীদের উপর ব্রিটিশদের অত্যাচার চরম সীমায় পৌঁছেছিল। অনেকেই নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ভেঙ্গে পড়েছিল। কিংসফোর্ড হত্যা মামলায় রাজসাক্ষী হয়েছিলেন তেমনই এক দুর্বলচিত্ত বন্দী। নরেন্দ্রনাথ গোস্বামী। কিন্তু বিপ্লবের পাঠে সহ্যের কোন সীমারেখা হয় না। যাঁরা অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আত্মসমর্পণ করে, তাঁরা নিতান্তই ভীরু। বিশ্বাসঘাতক। বিপ্লবীরা মনে করতেন, এমন বিশ্বাসঘাতকদের একমাত্র পরিণাম হওয়া উচিত - মৃত্যু। তাই নরেন গোঁসাইকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার ভার পড়ল আলিপুর জেলে বন্দী দুই অসমসাহসী বিপ্লবীর উপর। মতিলাল রায় কাঁঠালের মধ্যে করে রিভলভার পৌঁছে দিলো সেই দুই বিপ্লবীকে। শরীর খারাপের ভান করে এই দুই বিপ্লবী ভর্তি হলেন আলিপুর জেলের হাসপাতলে। তাঁরাও নাকি রাজসাক্ষী হতে চায়। এমন টোপ সহজেই গিলল বিশ্বাসঘাতক নরেন গোঁসাই। তারপর! ছদ্ম-রাজসাক্ষী হতে চাওয়া সত্যেন বোস আর কানাইলাল দত্তের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল বিশ্বাসঘাতকের শরীর। বিদ্রোহের কাব্যে বিশ্বাসঘাতকেরা এমন শাস্তি পায়। নিজের কাজ সম্পন্ন করে এই দুজনের মধ্যে একজন এগিয়ে গেলেন পুলিশের কাছে। স্বস্তির সঙ্গে ধরা দিলেন তাঁদের কাছে আবার। নিশ্চিন্তে এবার মৃত্যু পথে পা বাড়াবেন। তিনি জানেন দেশের প্রতি কর্তব্যে কোন ত্রুটি করেননি। কিংসফোর্ড হত্যা মামলা এবং নরেন গোঁসাইকে হত্যার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়েছিল কানাইলাল দত্তের। কিন্তু সেই নির্ভীক বিপ্লবী কোন আইনি সাহায্য নেন নি। কোর্টে দাঁড়িয়ে বুক চিতিয়ে স্বীকার করেছিলেন নিজের কীর্তির কথা। সসম্মানে, দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে। "দেয়ার শ্যাল বি নো অ্যাপিল"। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র বলেছিলেন "শ্যাল আর উইলের ব্যবহারটা কানাই আমাদের ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে গেল হে"।
এমন নির্ভীকচিত্তের বিদ্রোহী মানুষটিকে বেশি দিন বাঁচিয়ে রাখার সাহস করেনি ইংরেজরা। ১৯০৮ সালের ১০ই নভেম্বর নির্ধারিত হয়েছিল ফাঁসির দিন। ওই দিনেও তাঁর চোখে ছিল না কোন দুঃখের চিহ্ন। কোন আপশোসের কণা তাঁকে বিব্রত করে নি। শুধু কালো কাপড়ে নিজের মুখ ঢাকতে চাননি তিনি। যে মহান কর্তব্য সম্পন্ন করার জন্য তিনি মৃত্যুর পথে পা বাড়িয়েছিলেন সেই আলোতেই নিজের মৃত্যুকে বিলীন করে দিতে চেয়ে ছিলেন এই বিপ্লবী। "ডোন্ট ব্ল্যাকেন মাই ফেস", ফাঁসুড়ের হাত থেকে দড়িটা নিতে নিতে এ কথাই বলেছিলেন। দেশের স্বাধীনতার মঞ্চে সেদিন মিশেছিল আরো এক বিপ্লবীর দেহ। এরকম বলিদান সমূহের যোগফলেই প্রাপ্ত হয়েছে আজকের স্বাধীনতা। ১৮৮৮ সালে তৎকালীন সাবেক চন্দরনগর অর্থাৎ বর্তমান চন্দননগরে জন্ম হয় কানাইলাল দত্তের। জন্মাষ্টমীর রাতে আলো করে পৃথিবীতে এসেছিলেন। তাই তাঁর নাম রাখা হয়েছিল কানাইলাল। বাবা চুনিলাল দত্ত ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী। তাঁর ট্রান্সফারের সুবাদে কানাইলালের ছোটবেলা কেটেছে মুম্বাইতে। মা হারা এই ছোট্ট ছেলেটি দেশের মাটিতে খুঁজে পেয়েছিল মাতৃত্বের গন্ধ। তাই ছেলেবেলা থেকেই তাঁর আত্মা নিবেদিত ছিল দেশের জন্য। ষোল বছর বয়সে ফিরে আসেন জন্মস্থানে। ভর্তি হন ডুপ্লেক্স বিদ্যামন্দিরে। হুগলির মহসিন কলেজ থেকে বি এ পরীক্ষায় পাশ করেন।
কলেজে পড়াকালীন তিনি সংস্পর্শে এসেছিলেন প্রখ্যাত বিপ্লবী চারুচন্দ্র রায়ের। চারুচন্দ্র রায়ের কাছেই নানারকম শরীরচর্চার কায়দা শিখেছিলেন কানাইলাল। অন্তরে তাঁর সাহস তো ছিলই , বাকিটা চারুচন্দ্র রায়ের শিক্ষা, তাঁকে এক পরিপূর্ণ বিপ্লবীদের রূপান্তরিত করেছিল। তাঁর ফাঁসির পর জেলের ওয়ার্ডেন চারুচন্দ্র রায়মশাইকে বলেছিলেন "কানাইলালের মত আর ১০০ জন তরুণ থাকলে, এই দেশকে স্বাধীন হওয়া থেকে কেউ আটকাতে পারবেনা"। এই চারুচন্দ্র রায়ই কানাইলাল দত্তকে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া আন্দোলনের সময় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদান করার অনুপ্রেরণা দেন। বিপ্লবী দলের চন্দননগর শাখার অগ্রণী সদস্য হয়ে ওঠেন কানাইলাল। শ্রীশচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে পরিচালিত গোন্দলপাড়া বিপ্লবী দলের সঙ্গেও যুক্ত হন তিনি। তারপর ১৯০৮ সালে কলকাতায় এসে যুগান্তর দলের সদস্য হয়ে ওঠেন। তারপর ধীরে ধীরে সমস্ত সশস্ত্র আন্দোলনে যোগদান করেন এই নির্ভীক বিপ্লবী। জীবনের শেষ কয়েকদিন জেলে কাটানোর সময় তিনি নিজের ভাই ছাড়া আর কারোর সঙ্গে দেখা করেননি। তাঁর মৃত্যুর পর কোন পুরোহিতের মাধ্যমে কোন আচার-অনুষ্ঠান যাতে না করা হয়, সেই ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। দেশের পায়ে নিবেদিত এই মৃত্যু ছিল তাঁর আত্মার যোগসূত্র। তাই আচার-অনুষ্ঠান চান নি।ভারতের বুকে জন্ম নেওয়া এই বিপ্লবীর মৃত্যুর পর তাঁর অন্তরাত্মা বিলীন হয়ে ছিল দেশের মাটিতে।