মানুষের সেবা করার পাশাপাশি শিল্প-চর্চাও করেছেন এই চিকিৎসক

এক অদ্ভুত জ্বর হয় মানুষের। কাঁপুনি দিয়ে আসে। এই জ্বরের কারণ কী তা খুঁজে বেড়াচ্ছেন এক চিকিৎসক ও গবেষক। ইংল্যান্ডে এই জ্বরের প্রকোপ তেমনভাবে নেই, কিন্তু জ্বর এলে বাঁচার সম্ভাবনা থাকে না। এদিকে এই জ্বরের কারণ খুঁজে বের করা নেশার মতো পেয়ে বসেছে সেই চিকিৎসক ও গবেষককে। ১৮৯৪ সালে সেই চিকিৎসক ইংল্যান্ডে আসেন। সেখানে তাঁর পরিচয় ঘটে আরেক গবেষকের সঙ্গে। সেই গবেষক তাঁকে জানায় এক দেশের কথা, যে দেশে এই অদ্ভুত জ্বরে মানুষ মরে। কয়েক মাস ছাড়া এই জ্বর হয় সেই দেশের মানুষদের। দেশটির নাম ভারতবর্ষ। এই জ্বরের নাম ম্যালেরিয়া।

সেই নবীন চিকিৎসক ভারতবর্ষে আসেন। ভারতবর্ষে এসে তিনি খুঁজে বের করেন ম্যালেরিয়ার কারণ। একটা সন্দেহ ভেতরে ভেতরে তৈরি হয়েছিল। ম্যালেরিয়া রোগের আসল কারণ এক বিশেষ প্রকার পরজীবী, সেই নবীন চিকিৎসক এটা বুঝতে পেরেছিলেন অনেক আগেই। কিন্তু প্রমাণের জন্য দরকার ছিল দীর্ঘ গবেষণা। এই গবেষণার ফলে জানা যায় ম্যালেরিয়া ছড়ানো পরজীবীর নাম। প্লাসমোডিয়াম ভাইভ্যাক্স। চিকিৎসা-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এ এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। ম্যালেরিয়ার পরজীবীর এই খোঁজ পাওয়া পর্যন্ত পথে সেই নবীন চিকিৎসককে সহ্য করতে হয়েছে অনেক বাধা। তবুও নিজের কাজকে সেবার মত করে দেখেছেন তিনি। অবশেষে সফল হয়ে বাঁচিয়েছেন অজস্র মানুষকে। এমনকি ম্যালেরিয়ার পরজীবীর খোঁজ করা একটা পাগলামি এই মনে করে, ম্যালেরিয়ার প্রকোপহীন অঞ্চলে কাজের জন্য পাঠানো হত সেই নবীন চিকিৎসককে। সব বাধা উপেক্ষা করে এই বিজ্ঞানী ভেবেছিলেন মানুষের কথা। এমনই আশ্চর্য মানুষ ছিলেন রোনাল্ড রস।

জন্ম উত্তর ভারতের আলমোড়ায়। পার্বত্য অঞ্চলে জন্ম তাঁর। ১৮৫৭ সালের ১৩ই মে। মাত্র ৮ বছর বয়সে তাঁকে ইংল্যান্ডে পাঠানো হয় পড়াশোনার জন্য। পড়াশোনায় মেধাবী হলেও ইচ্ছে ছিল শিল্পী হওয়ার। গান, কবিতাচর্চা এসব নিয়েই থাকতেন‌। তবে ভালবাসতেন অংক করতে। বাবা ছেলের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন অন্য এক মানব-সত্তা। যে মানব মন কৌতূহলী, সেবা-অন্ত-প্রাণ। তাই বাবা চেয়েছিলেন ছেলে চিকিৎসক হোক। তবুও ছেলে মানতে চায়নি। বাবা সেই সময় ছেলেকে জীবনের পাঠ পড়ান। শিল্প-চর্চা খানিকটা হলেও বিলাসিতা। অন্তরের খিদে মেটানোর সহায়ক। কিন্তু জীবন আসলে রূপকথার বাইরের এক ক্ষতবিক্ষত চিত্র। মানুষের সেবাই একমাত্র সেই রূপকথাকে পূর্ণতা দিতে পারে।

অবশেষে রাজী হল ছেলে। ১৮৭৪ সালে লন্ডনের একটি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন রোনাল্ড রস। শুরু হয় ডাক্তারি পড়াশোনা। মেধাবী ছেলের ফলাফল তাক লাগিয়ে দিত সকলকে। ১৮৭৯ সালে রোনাল্ড রস রয়্যাল কলেজ অব সার্জন্সের সদস্য হন।১৮৮১ সালে তিনি বিএসসি ডিগ্রী অর্জন করেন।

এক জাহাজের সার্জেন্ট হিসেবে তিনি যোগদান করেন ১৮৮১ সালে। সৈন্যবাহী ওই জাহাজ রোনাল্ড রসকে দিয়ছে নানা অভিজ্ঞতা। মাদ্রাজ, বার্মা, ব্যাঙ্গালোর, আন্দামানে তিনি কাজ করতেন। এই কর্ম অভিজ্ঞতা তাঁর সঙ্গে পরিচয়  করায় এক অদ্ভুত কাঁপুনি দেওয়া জ্বরের সঙ্গে। যার নাম ম্যালেরিয়া। কিন্তু কিছুতেই ম্যালেরিয়া রোগের প্রকৃত কারণ তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। জাহাজে ঘুরে ঘুরে কাজ করার সময় তিনি দেখেন মশাকে জল থেকে দূরে রাখলে তার জন্ম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

১৮৯৪ সালে রোনাল্ড রস দ্বিতীয়বার ইংল্যান্ডে পৌঁছন। আলাপ হয় আরেক গুণী মানুষের সঙ্গে। প্যাট্রিক ম্যাসন। এই গবেষক রোনাল্ড রসকে মানবদেহে ম্যালেরিয়ার জীবাণুদের সঙ্গে পরিচয় করান। ম্যাসন রোনাল্ডকে পরামর্শ দেন ভারতে আসার। ম্যালেরিয়া নিয়ে গবেষণার আদর্শ স্থান ভারতবর্ষ।  ম্যাসনের পরামর্শে ভারতে এসে পৌঁছন রোনাল্ড রস।

রোগ, মহামারীতে ভারত তখন জর্জরিত। প্রথমে মুম্বাইয়ে সিভিল হাসপাতালে তিনি পরীক্ষা করেন। বিশেষ কোন লাভ হয়নি। ১৮৯৭ সালে তিনি বাদামী মশার লার্ভা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করেন। এই পরীক্ষায় তিনি নিশ্চিত হন যে কোন পরজীবী মশার মাধ্যমে ম্যালেরিয়া ছড়ায় না। আবার সব প্রজাতির মশাই ম্যালেরিয়ার বাহক নয়।

১৮৯৭ সালের ২০শে আগস্ট তিনি এক বিশেষ ধরনের মশার অন্ত্রে ম্যালেরিয়া পরজীবীর খোঁজ পান। পরবর্তীকালে মশার এই প্রজাতি অ্যানোফিলিস নামে পরিচিত হয়েছে। রোনাল্ড রস আরো প্রমাণ করেন স্ত্রী-অ্যানোফিলিস মশাই দায়ী ম্যালেরিয়া ছড়ানোর জন্য। উন্নত প্রযুক্তির সাহায্য ছাড়াই প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করেছিলেন এই বিজ্ঞানী। সঙ্গী ছিল অদম্য জেদ ও সাহস। হুসেন খান নামে এক রোগীর ওপর তিনি এই পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। ম্যালেরিয়ার পরজীবী অর্থাৎ প্লাজমোডিয়াম ভাইভ্যাক্সের বাহক মশাগুলির রঙিন বা বিশেষ দাগযুক্ত জানা থাকে। রোনাল্ড রসের প্রচেষ্টায় অবশেষে ম্যালেরিয়ার মশাদের আলাদা ভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। ভারত ঋণী এই প্রত্যয়ী চিকিৎসকের কাছে। ১৮৯৭ সালের ২৭শে আগস্ট দ্য ইন্ডিয়ান মেডিকেল গেজেটে রোনাল্ড রসের আবিষ্কারের কথা প্রকাশিত হয়।

ম্যালেরিয়া রোগ নিয়ে আরও গভীরে পরীক্ষা করতে চাইছিলেন রোনাল্ড রস। তখন তিনি পাখির ওপর পরীক্ষা করেন। তিনি দেখতে পান কিউলিক্স মশা পাখির দেহে হওয়া ম্যালেরিয়ার প্রজাতীর মধ্যবর্তী আশ্রয়দাতা অর্থাৎ হোস্ট হিসেবে কাজ করে। তিনি গবেষণায় বুঝতে পারেন ম্যালেরিয়া জল বা বায়ুবাহী কোন রোগ নয়, এটি একটি সংক্রামক ব্যাধি যা একজনের শরীর থেকে আরেকজনের শরীরে মশার মাধ্যমে সংক্রামিত হয়।

১৮৯৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রোনাল্ড রসকে রাজস্থানের একটি ম্যালেরিয়া মুক্ত অঞ্চলে কাজ করতে পাঠানো হয়েছিল। এর আগেও ব্যাঙ্গালোরে পাঠানো হয়েছিল। ভারি বিরক্ত হয়েছিলেন তিনি। ম্যালেরিয়াবিহীন অঞ্চল মানেই তাঁর পরীক্ষার বিষয় নেই। কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না রোনাল্ড রস। আবার কলকাতায় ট্রান্সফার করা হয় তাকে। পিজি হাসপাতালে তিনি ম্যালেরিয়া সম্বন্ধে বাকি গবেষণা শেষ করেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের অস্বাস্থ্যকর আবহাওয়া এবং পরিছন্নতা সম্বন্ধে অজ্ঞতা ম্যালেরিয়া ছড়ানোর অন্যতম কারণ। তিনি এই সংক্রান্ত সচেতনতা প্রসারের চেষ্টা করেছিলেন। মহানদ গ্রামে একটি বাড়ি কিনে সেখানে পরীক্ষাগার তৈরি করেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন গ্রাম থেকে মশা সংগ্রহ করে সেখানে পরীক্ষা করতেন। সেখানে তিনি দেখেন মশার লালাগ্রন্থিতে ম্যালেরিয়া পরজীবী থাকে।

এরপর নানা চড়াই-উৎরাইয়ের কারণে তিনি ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিস থেকে পদত্যাগ করে ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। পশ্চিম আফ্রিকার ম্যালেরিয়া বিরোধী প্রকল্পগুলির তদন্ত শুরু করেছিলেন এখানে। তিনি এরপর রয়েল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯০২ সালে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় তাঁকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন রোনাল্ড রসকে ভারতীয় সেনাদের ট্রপিকাল ডিজিজ-এর ব্যাপারে মূল পরামর্শদাতা হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যচর্চাও করে চলেছিলেন তিনি। তবে গবেষণার বিষয়কে কখনো অবহেলা করেননি। এই নিয়ে বহু প্রবন্ধ, নিবন্ধ লিখেছেন। প্রতিবছর ২০শে অগাস্ট তাঁর ম্যালেরিয়া পরজীবীর বাহক হিসেবে মশার ভূমিকা আবিষ্কারের দিনটিকে বিশ্ব মশা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। তাঁর নিরলস গবেষণা এই বিশ্বকে রোগমুক্ত হতে সাহায্য করেছিল। ভারতবর্ষ এই মহান বিজ্ঞানের কাছে আজও ঋণী।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...