হালের বাঙালির ইংরেজি না হলে একেবারেই চলে না। কিন্তু এই বাঙালির ইংরেজি শেখার সূত্রপাত ঘটেছিল আরেক বাঙালির হাত ধরে। বাঙালিকে ইংরেজি শেখানোর কারিগর হলেন প্যারীচরণ সরকার। তাঁর ফার্স্ট বুক পড়েই রবি ঠাকুরেরও ইংরেজিতে হাতেখড়ি হয়েছিল। নারী শিক্ষার অগ্রদূত, সমাজ সংস্কারক এবং উনিশ শতকের বাঙলার পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা ছিলেন তিনি। পরাধীন দেশে স্বজাতিকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চেয়েছিলেন তিনিই। বাঙালিকে ইংরেজি ভাষার সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিলেন তিনিই। বাংলার নারী শিক্ষায় অনন্য অবদানের জন্যে তাঁকে 'প্রাচ্যের আর্নল্ড' বলা হত। প্যারীচরণ সরকারের জন্ম ১৮২৩ সালেল ২৩ জানুয়ারি উত্তর কলকাতার চোরবাগানে।
১৮৪৩ সালে হিন্দু কলেজ থেকে পড়াশোনার পাঠ শেষ করে কিছুকাল হুগলির এক ব্যাঙ্কে চাকরি করেছিলেন প্যারীচরণ। তাঁরা হুগলির আদিবাসিন্দা ছিলেন। তাঁদের পারিবারিক পদবি ছিল দাস, পরবর্তীকালে তাঁরা সরকার উপাধি পান। হুগলি স্কুলে শিক্ষকতার পর তিনি বারাসতের গভর্নমেন্ট স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পান। ১৮৪৬-১৮৫৪ পর্যন্ত তিনি এই স্কুলে কর্মরত ছিলেন। কৃষি বিদ্যালয় স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকাও পালন করেন। কলুটোলা ব্রাঞ্চ স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদে আট বছর আসীন ছিলেন তিনি। যা হেয়ার স্কুল নামে পরিচিতি পায়। ১৮৬৩ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের অস্থায়ী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন প্যারীচরণ সরকার।
প্যারীচরণ সরকার ছাত্র পড়াতে গিয়ে দেখলেন, ছাত্রদের জন্য পূর্ণাঙ্গ ইংরেজি শেখার বই নেই। তখন তিনি নিজেই লিখে ফেললেন 'ফার্স্ট বুক অফ রিডিং ফর নেটিব চিলড্রেন'। যা ১৮৫০ সালে 'স্কুল বুক প্রেস' থেকে প্রকাশিত হয়। পরে তিনি এর দ্বিতীয় ভাগও লিখেছিলেন। প্যারীচরণ সরকার শুধু লেখেননি, নিজে বই ছাপাতেনও। উত্তর কলকাতায় আজও তাঁর বাড়ি রয়েছে, তবে বাড়ির দশা একেবারেই করুণ।
১৮৪৬ সাল থেকে তিনি বারাসত গভর্নমেন্ট স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সেই সময় ১৮৪৭ সালে বারাসাতের দুই ভাই নবীন কৃষ্ণ মিত্র এবং কালীকৃষ্ণ মিত্র, প্যারীচরণ সরকারের কাছে স্কুল স্থাপনের প্রস্তাব দেন। তাঁরাই বাংলার প্রথম বেসরকারী বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা জন্য অর্থ দেন। বহু বাধা পেরিয়ে প্যারীচরণ অবশেষে স্কুল স্থাপন করেন। আজ যা কালীকৃষ্ণ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নামে পরিচিত৷ ১৮৪৮ সালে বেথুন ওই বিদ্যালয় পরিদর্শনে গিয়ে এতটাই প্রীত ও প্রাণিত হয়েছিলেন যে ১৮৪৯ সালে মেয়েদের জন্য বেথুন কলকাতায় স্কুল স্থাপন করেন। ১৮৬৬ সালে তিনি এডুকেশন গেজেট পত্রিকার দায়িত্বে আসেন, এরপরে ওয়েল উইশার এবং হিতসাধক নামক দুটি সংবাদপত্র প্রকাশ করেছিলেন প্যারীচরণ। নারী শিক্ষাকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে ১২৮২- ১২৮৩ বঙ্গাব্দে বঙ্গ মহিলা পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন।
বাংলার নবজাগরণেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন প্যারীচরণ। স্ত্রীশিক্ষা প্রচারে একাধিক বিদ্যালয় স্থাপন থেকে শুরু করে বিধবা বিবাহ প্রচলনে বিদ্যাসাগরকে সাহায্য সবক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন প্রথম সারিতে৷ নারী শ্রমিকদের সন্তানদের সুশিক্ষা লাভের জন্য তিনি কারিগরি বিদ্যালয়ও স্থাপন করেছিলেন। ১৮৭৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর অর্থাৎ আজকের দিনেই কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়েছিল।