'ফ্যাতাড়ু'। এরা সমাজ নামক অপপ্রতিষ্ঠানটির দুয়ো ভোগে চিরকাল। অপমানিত হয়, নির্যাতিত হয়, শোষিত হয়, বঞ্চিত হয়, প্রতিবাদী হলে ধিক্কৃত হয়। এরাই ভাষার আগল ভেঙে তাকে নতুন করে নির্মাণ করে--সেক্ষেত্রে এরা কখনই শুদ্ধাচারী নয়, এরা সাহসী, বেপরোয়া, খিস্তিমুখর। চরম বাস্তব এবং ফ্যান্টাসির মিশেলে চরিত্র হিসেবে এদের নির্মাতা, নবারুণ। এদের নিয়েই তিনি লিখেছেন--'ফ্যাতাড়ুর কুম্ভীপাক', 'ফ্যাতাড়ুর বোম্বাচাক', 'ফ্যাতাড়ু বিংশতি'--গল্পমালা। আসলে এরা নবারুণ ভট্টাচার্যের অল্টার ইগো। তিনি যে কথাগুলো নিয়ে রাস্তায় নেমে সোচ্চার হতে পারেন না, তাই-ই বলতে ভয় পায় না ফ্যাতাড়ুরা--
"কেহই বোঝেনি মোরে
কেহই বাঁধেনি ডোরে
কেহই দেয়নি গলে মালা
সকলেই লাথায়েছে
বড়শিতে গাঁথায়েছে
বলিয়াছে, মর তুই শালা!
তাই আমি বলি ধিক!
হাসি শুধু ফিক ফিক
গোপনে করিয়া যাই ট্রাই,
করে সবে শালাগণে
জড়ো করি কচুবনে
একযোগে করিব জবাই!"
ফ্যাতাড়ুরা চায় আদিম-নৈরাজ্য। চায়, মানবিক সম্মান। চায়, প্রতিষ্ঠান নিপাত যাক! তাই নবারুণ স্পষ্টই বলেছেন, তাঁকে বুঝতে হলে আগে ফ্যাতাড়ুদের বুঝতে হবে। তবে, উল্টোটা বুঝলেও চলে।
নবারুণ ভট্টাচার্য ব্যতিক্রমী লেখক। কেন ব্যতিক্রমী, কেন? তাঁর দর্শনের জন্য, ভাষার জন্য, তাঁর পদ্য বা গদ্যের শরীর নির্মাণের জন্য। এবং, অন্তর্নিহিত বিষয়ে তাঁর সমস্ত রচনাই রাজনৈতিক। তবে, তিনি তাঁর রাজনৈতিক মত পাঠকের ওপর চাপিয়ে দেন না, তাঁর পদ্য-গদ্যের শরীরে দর্শনের ছোঁয়ায় তা এমনভাবে সম্পৃক্ত থাকে যে, তাকে সচেতন বিদগ্ধ পাঠক কিছুতেই অস্বীকার করতে পারেন না। মতাদর্শে তিনি বামপন্থী, কিন্তু, প্রাতিষ্ঠানিক বামপন্থার কেউ নন। আসলে, কোন প্রতিষ্ঠানেরই তিনি কেউ নন। কৈশোরে তিনি বাবা-মা বিজন-মহাশ্বেতার বিবাহমূলক প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্কের ভাঙন দেখেছেন। মা তাঁকে নিয়ে ঘর ছেড়েছেন। বাবা সান্নিধ্য দিতে চেয়েছেন। ত্যাগ-গ্রহণের ভেতর দিয়ে স্বাধীনতা পরবর্তী জীবনে প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির অন্তঃসারশূন্যতা দেখেছেন। যুদ্ধ দেখেছেন। নকশালী নিধন দেখেছেন। ঋদ্ধ হয়েছেন, বিদ্ধ হয়েছেন। আঙুল তোলার স্পর্ধা করেছেন। তাই উপন্যাস সমগ্রের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন--"যে তাগিদ থেকে আমি লিখি তার সঙ্গে বাজারের সম্পর্ক প্রায় নেই বললেই চলে। ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক রদবদলের যে বিচিত্র ও ট্র্যাজিক সময়ের আমি সাক্ষী তার অনুরণন আমার আখ্যানে রয়েছে--কখনও আমি অংশীদার এবং সব সময়েই ভিক্টিম।" তাঁর লেখায় এই যে তীব্র রাজনৈতিক সচেতনতা, তার পাঠ তিনি অবশ্য পেয়েছিলেন বাবা বিজন ভট্টাচার্যের সান্নিধ্যে। যৌবনে বাবার সঙ্গে নাটকে অভিনয় করেছেন। প্রথম অভিনয়, 'গোত্রান্তর'-নাটকে। তারপর, 'দেবী গর্জন'। বাবার লেখা, বাবা পরিচালনা, বাবা সহ-অভিনেতা। এই অমূল্যসঙ্গই তাঁকে দিয়েছিল চেতনায় মুক্তি। তাই একটি সাক্ষাৎকারে নবারুণ বলেছেন--'শিল্পীকে যে ক্রয় করা যায় না এটা আমি বাবার কাছ থেকে শিখেছি।'...'সব দিক থেকে বাবাই ছিলেন আমার আদর্শ।' পক্ষান্তরে সহযোদ্ধা ও বন্ধু হয়ে ওঠা ছেলেকে বাবা বলেছিলেন--'বড় হয়ে তুমি লিখবে!'--প্রশ্রয়ের এই আশ্রয় সবার ক্ষেত্রে জোটে না!
নবারুণ কবি। নিজেকে তিনি তাই-ই বলতেন বটে। তবে, প্রথম থেকেই তাঁর হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে, নিজেকে প্রকাশ করার মাধ্যমে নিয়ে কোন বাছবিচার ছিল। কবিতা, গল্প, নাটক, অনুবাদ--কিছুই বাদ যায়নি তাই তাঁর কলম থেকে। প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়েছিল 'পরিচয়' পত্রিকায়। ১৯৬৮ সালে। গল্পের নাম, 'ভাসান'। নামটি অবশ্য দিয়েছিলেন পত্রিকার সম্পাদক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তবে, তাঁর কবিতা ঝড় তুলল সাতের দশকে নকশালী প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লেখা--'এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না'।
নবারুণ উপন্যাস রচনায় হাত দিলেন নয়ের দশকে এসে। 'হারবার্ট' রচনার মধ্য দিয়ে। তাঁর লেখায় স্বদেশ ভাবনার সঙ্গে পাঠ পরিধির বিস্তারে, অনুষঙ্গ-নির্মাণের নৈপুণ্যে বাঙালিত্ব-জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা পরতে পরতে এক হয়ে যায়। যেমন, তাঁর লেখা এ-শতকের উপন্যাস--'লুব্ধক'। সেখানে বাহ্যিক বিবরণে কলকাতাকে কুকুরশূন্য করে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। শহরের রাস্তায় তারা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু, অবাঞ্ছিত ভিড় এবং নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়। এই উদ্যোগের সঙ্গে তিনি অনুষঙ্গে এক করে দিলেন ব্রাজিলিয়ান মিরাকলের পর সামরিক বাহিনীর সাহায্যে বুর্জোয়ারা রাস্তার ভিখারি ও তাদের সন্তানসন্ততিদের নির্মূল করতে নামার ঘটনা। জার্মানির নাৎসিবাহিনী যেভাবে সস্তায় প্রচুর ইহুদি নিধন করেছিল, লেখকের ভাষ্যে কলকাতার প্রশাসন সেভাবেই কুকুর নিধন করতে চায়। বুননের মুন্সিয়ানায় এভাবেই সামান্য কুকুর নিধনের করুণ কাহিনিকে তিনি আন্তর্জাতিক ভাবনাঋদ্ধ 'আমাদের' গল্পে পরিণত করে ফেলেন। এবং তা, মীনের চোখে অর্জুনের অব্যর্থ লক্ষ্যভেদে। কথনের এই ধারাটি যে একেবারেই নতুন তা নয়--সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সুবিমল মিশ্র--প্রমুখ সাহিত্যিকদের প্রথাবিরোধী গল্পসাহিত্য আন্দোলনেরই বিস্তার ঘটেছে নবারুণে এসে। সঙ্গী, ফর্মে-ভাষায়-আইডিয়ায় স্বকীয়তা। এখানেই নবারুণের নবত্ব।