বিমল রায় এক আলোক পুরুষ

ছোট থেকেই খুব ভালোবাসতেন ছবি। ফটোগ্রাফির প্রতি অমোঘ টান। শুধু ছবি নয়, সঙ্গে আলোও। ছবিতে আলো ছায়ার খেলা যেন অন্য মানে নিয়ে ধরা দিত তাঁর কাছে। ক্যামেরায় সেই আলোর টানেই বদলে গেল কলকাতার নিউ থিয়েটার্স লিমিটেডের ক্যামেরা সহযোগীর জীবন।

বিমল রায়। জন্ম ১২ জুলাই। সালটা ১৯০৯। বাংলাদেশের সূত্রধরপুরের জমিদার বাড়িতে। জমিদারতনয় হলেও সুসময় পদ্ম পাতার জল।  স্কুলে পড়তে পড়তেই বাবাকে হারালেন। অথৈ গাং যেন অপেক্ষা করছিল কিশোর বিমলের জন্য। এক বন্ধু পরামর্শ দিল কলকাতা পাড়ি দিতে। সেখানে গেলে ফিরতে পারে ভাগ্যের চাকা। জন্মের ভিটে পিছনে রেখে চলে এলেন তিনি। সঙ্গে মা আর এক রত্তি ভাই।

চেষ্টা করে নিউ থিয়েটার্সে চাকরি মিলল। পিসি বড়ুয়ার আওতায়।

ক্যামেরাকে যেন নতুন ভাবে আবিষ্কার করলেন তিনি। ক্যামেরায় আলোর ব্যবহার তাঁকে আলাদাভাবে নজরে ফেলল। আলোর ব্যবহার কীভাবে হওয়া উচিত সে নিয়ে ভাবনা চিন্তা এবং তার প্রথম ব্যবহারিক প্রয়োগ শুরু করলেন।

ছবির সকাল, দুপুর, বিকেল গুলো ধরা পড়তে লাগল দর্শকদের চোখে। গল্প বলার ধরনেও পরিবর্তন এল। ক্যামেরায় ‘দেখা’র দৌলতে।

বিমল রায়ের প্রথম বাংলা ছবি ‘উদয়ের পথে’। তারপরই বোম্বাই পাড়ি দিলেন। কলকাতায় ছবির বাজারে তখন হঠাৎ মন্দা। তিনি একা বোম্বাই গেলেন না, সঙ্গে প্রায় আনকোরা ‘টিম’।

নতুন শহরে ঘুরে দাঁড়াতে দু’ বছরের বেশি সময় লাগল না। ১৯৫২-তে বম্বে টকিজের জন্য করলেন প্রথম হিন্দি ছবি। হলিউড ছবি ‘ওভার দ্য হিলস’-এর আধারে ‘মা’। মা আর ছেলের গল্প। ওই বছরেই পেলেন জীবনের প্রথম বড় ব্রেক ‘ দো বিঘা জমিন’। বদলে গেল তাঁর ভাগ্যের চাকা। সঙ্গে ভারতীয় সিনেমার ইতিহাস।

সলীল চৌধুরীর লেখা গল্প। স্ক্রিন প্লে লিখেছিলেন হৃষিকেশ মুখার্জি। জমি হারিয়ে শহরে আসা এক কৃষক রিকশার চাকায় নিজের ভাগ্য খুঁজতে যায়। সঙ্গে নাবালক পুত্র। অচেনা শহরে অসহায় পিতা-পুত্রের মাটি কামড়ে থাকার সংগ্রাম ছবির মূল বিষয়।  জমিহারা কৃষকের নিদারুণ পীড়ন কাহিনী আলোড়ন ফেলেছিল। সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশ এমন ছবিতেই খুঁজে পেয়েছিল স্বজাতিকে। বিদেশেও ছবি প্রশংসা পেয়েছিল। চীন, রাশিয়া, কান, ভেনিস, মেলবোর্ন কোথায় নয়! দেশের সর্বকালের সেরা ১০ ছবির মধ্যে ‘দো বিঘা জমিন’ সেরার আসনে চিরন্তন।

এই ছবি এক ধাক্কায় পাকাপাকি ভাবে বদলে দিয়েছিল ভারতীয় সিনেমার ভাষা।  ছবির সিনেম্যাটিক ভাষা ছবির দুনিয়ায় ‘রেফারেন্স বুক’। তিনি নিজে ভীষন ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন ইতালির নিও- রিয়েলিস্টিক আন্দোলনের দ্বারা। নিজের ছবিতে সেই ধারার প্রয়োগ ঘটিয়ে ছিলেন সচেতনভাবেই। তাই ছবিতে চরিত্র রক্ত মাংসের মানুষ হিসেবেই এসেছে। তারা ‘ হিরো’ বা অতিমানব নয়। তারা হাসে, কাঁদে, কষ্ট পায়, আবার হেরেও যায় নিতান্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই। কোনও আলোড়ন হয় না। প্রতিশোধ নিতে জানে না, বাস্তবের শিকলে অসহায় বন্দি। ছবি জুড়ে সোশালিস্ট রিয়েলিস্টিক ট্রিটমেন্ট। আসলে শুরু থেকেই ‘হিউম্যানিজম’ ছিল তাঁর ইস্তেহার। সেই জন্যই সুবোধ ঘোষের কাহিনীতে ‘সুজাতা’ বানাতে পেরেছিলেন। জাত বিদ্বেষের বিরুদ্ধে এক হরিজন কন্যার কাহিনী।

জীবদ্দশায় ১১ টি ফিল্মফেয়ার পেয়েছিলেন। দেশ বিদেশে অজস্র পুরস্কার। ‘মধুমতি’ ‘দেবদাস’ ‘পরখ’ ‘পরিণীতা’র মতো মাস্টারপিস। কিন্তু তাঁর শেষ কথা ছিল দর্শক। তবে আবেগ জর্জর ফাঁপা ছবি নয়। তাঁর ছবি কথা বলত বৌদ্ধিক ভাষায় এবং যা আপাদমস্তক রেডিক্যাল।

খুব কম কথার মানুষ ছিলেন। কথার চেয়ে অনেক বেশি বিশ্বাস করতেন কাজে। আদতে কর্মযোগী বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন তাই। নিজের কাজে বুঁদ হয়ে থাকতেন দিন থেকে রাত। বিশ্বাস করতেন এমন ছবি বানাবেন যা পুরো পরিবার এক সঙ্গে বসে দেখতে পারবে।

সেই ভাবনার অন্যথা ঘটেনি কোনদিনই। নিজেই হয়ে উঠেছিলেন ‘স্কুল’। তৈরি হয়েছিল ‘ বিমল রায় ঘরানা’। হৃষিকেশ মুখার্জি, গুলজার, সলীল চৌধুরী, বাসু ভট্টাচার্য এঁরা সকলেই সেই স্কুলের সফল ছাত্র।

নিউ এজ ভারতীয় ছবি আজও বয়ে যাচ্ছে তাঁর ধারাতেই। শুধু ব্যাটন বদলেছে মাত্র।

 

তথ্য ঋণ: A man who spoke in pictures- Rinki Bhattacharya

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...