গুরুগম্ভীর ক্লাসরুম। ব্ল্যাকবোর্ডে খসখস করে লিখে চলেছেন বাঘা দিদিমণি। ঘাড় ঘোরাবার জোটুকু নেই। জানলা দিয়ে গায়ে এসে লাগছে বসন্ত হাওয়া। সে বাতাসে ভর দিয়ে ফি বছর ঘরে ঢোকে পরীক্ষার ভূত। হুশ করে অ্যানুয়ালের ভয়! তবু তার মধ্যেই পেন চলে। লাল-সবুজ পেনের কালিতে আনাড়ি হাত লিখে চলে বুক চিনচিনে ব্যথার কথা। গোধূলি বিকেলে নাম না জানা নেশা পেয়ে বসে রোজ। টিউশন ক্লাসের মাঝ বেঞ্চে চোখ চলে যায় বেপরোয়া। তার চিবুকের নীচে তিল। নোটের খাতার ভিতর লুকিয়ে রাখা ভাঁজ করা সেই খাম। কে পৌঁছে দেবে তার হাতে?
প্রেমের ইস্তেহার চিঠি। টেক্সট, ইমোজি, ডেটিং অ্যাপের যুগে কে বা কাকে পাঠায় নীলখামে ভরা ভালবাসার চিঠি? কিন্তু এই চিঠির অভ্যাস যে ৪ হাজার বছরের পুরনো। পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রেমপত্র সেই চিঠি মানে, আজ এক খণ্ড পাথুরে মাটি। পাওয়া গিয়েছিল মেসোপটেমিয়ার ক্যালডিয়া-য়। ২২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে লেখা সেই চিঠি লিখেছে ব্যাবিলনের এক ছেলে। তার প্রেমিকা থাকত ইউফ্রেটিস নদীর তীরে তীরের সিপারা শহরে।
তখন চিঠি লেখা হত মাটির টুকরোয়, প্যাপিরাসে। এক হাত থেকে আর এক হাতে পৌঁছেও যেত সেই চিঠি।
ব্রিটিশ লাইব্রেরি, আর অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির দুই কলেজে সংরক্ষিত আছে ‘প্যাস্টন লেটার্স’।পঞ্চদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডে সম্ভ্রান্ত প্যাস্টন পরিবারের কয়েক পুরুষের চিঠিপত্রের সংগ্রহ। সেই সংগ্রহেই আছে সেই পরিবারের জন প্যাস্টনকে লেখা তার প্রেমিকা মার্গারি ব্রিউসের চিঠি। যে চিঠির সম্বোধন ‘মাই রাইট ওয়েল-বিলাভেড ভ্যালেন্টাইন’।
সনাতন ভারতেও প্রেমাস্পদের কাছে গোপনে দূতি মারফত বার্তা পাঠানোর চল বহু পুরাতন। সেই যে বিরহী যক্ষ দূত করেছিল মেঘকে। শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধের ৫২ অধ্যায়ে রুক্মিণী চিঠি পাঠায় দূত সুনন্দকে দিয়ে।প্রাণ সঁপেছেন যে কৃষ্ণকে!
চিঠির সেই কাল হারিয়ে গিয়েছে। এখন কেউ কাউকে আর প্রেমের চিঠি লেখে না। বদলে টেক্সট আসে। আবেগ বোঝাতে ইমোজি। কথা ফুরিয়ে আসে। হাতের লেখায় স্পর্শ হারিয়ে যায়। সময়ের দলিল হয়ে বেঁচে থাকে প্রেমের চিঠি। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট প্রেমের প্রেমের চিঠি লিখেছিলেন প্রথম স্ত্রী জোজেফিনকে। বিয়ের মাত্র দুই দিন পরই ইতালি অভিযানে গিয়ে স্ত্রী বিরহে ব্যাকুল হয়েছিলেন নেপোলিয়ন। নববধূ জোজেফিনকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে চিঠিও লিখেছিলেন তিনি। ফেনি ব্রাউনীকে লিখেছিলেন জন কিটস। বি লর্ড বায়রন লিখেছিলেন তেরেসা।
বিরহ হৃদয় আবেগকে বেঁধে রাখে কাগজে কলমে। মন নিংড়ে কথা আসে। যে কথা বলি বলি করেও বলা হয় না, সেই কথায় যেন আগল ভেঙে সমুদ্রের ঢেউ হয়ে প্রকাশ পায়। চিঠির যুগ হয়ত ফুরিয়েছে কিন্তু চিঠি পাওয়ার ব্যকুলতা রয়ে গিয়েছে একই, অক্ষয় হয়ে...