কাশীর সচল বিশ্বনাথ বলা হতো ত্রৈলঙ্গ স্বামীকে! মৃত মানুষকে জীবিত করা থেকে শুরু করে যাত্রীবাহী নৌকা ডুবে গেলে তাকে আবার জলের বুকে ভাসিয়ে দিতেন তিনি! ত্রৈলঙ্গ স্বামী, যার মাহাত্ম্য অনুভব করেছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব থেকে শুরু করে স্বামী বিবেকানন্দ পর্যন্ত! কিন্তু তার বিষয়ে কতটুকু জানা যায়? কোথায় তার জন্ম? কার কাছেই বা তিনি নিয়েছিলেন সন্ন্যাস দীক্ষা? কী ছিল তার পূর্বাশ্রমের নাম? অনেকেই হয়তো জানেন না দীক্ষা নেওয়ার পর তার দীক্ষিত নাম কিন্তু ত্রৈলঙ্গ স্বামী হয়নি, এমনকি পূর্বাশ্রমে ও তার নাম ত্রৈলঙ্গ স্বামী ছিল না,তাহলে কীভাবে এই নাম পেলেন তিনি?
হ্যাঁ বন্ধুরা, আজকে আমি আপনাদের বলব কাশীর সচল শিব ত্রৈলঙ্গ স্বামীর জীবনী ও লীলা মাহাত্ম্য বিষয়ক সেইসব কথা, যা আপনাদের মনের কৌতূহল মেটাবে।
মাদ্রাজ প্রদেশের হোলিয়া গ্রামে ত্রৈলঙ্গ স্বামী জন্মগ্রহণ করেন, বাবার নাম নরসিংহ রাও ও মাতার নাম বিদ্যাবতী। শিবের কৃপায় জন্ম হওয়া এই শিশুর নাম তারা রাখেন শিবরাম। পরবর্তীতে এই শিশু ত্রৈলঙ্গ স্বামী নামে পরিচিত হন। শিবরামের যখন ৪০ বছর বয়স তখন তার পিতা নরসিংহ রাওয়ের মৃত্যু হয় আর মাতা বিদ্যাবতীর যখন মৃত্যু হয় তখন ত্রৈলঙ্গ স্বামীর বয়স ৫২ বছর। মায়ের মৃত্যুতে সংসারের যেটুকু বন্ধন ছিলো, সেটুকুও ছিঁড়ে গেল,মায়ের মৃত্যুর পর সেই যে বেরলেন, আর ঘরে ফেরেননি তিনি।
গ্রামের শ্মশানের একটি প্রান্তে কুটির বেঁধে যোগ সাধনায় ডুবে থাকতেন তিনি। এইভাবেই কেটে গেল দীর্ঘ কুড়ি বছর। তারপর তৈলঙ্গ স্বামী পেলেন তার দীক্ষাগুরু পাঞ্জাবি সাধক ভগীরথানন্দ সরস্বতীর সাক্ষাৎ। গুরুদেবের সাক্ষাৎকার পেয়ে হোলিয়া গ্রাম চিরকালের মতো ছেড়ে দেন শিবরাম। এরপর তিনি তার দীক্ষাগুরুর সাথে নানা তীর্থে ঘুরে বেড়াতে থাকেন। পুরো দক্ষিণ ও উত্তর ভারত পর্যটনের পর এরপর এই দুই মহাসাধক অর্থাৎ দীক্ষাগুরু ভগীরথানন্দ সরস্বতী ও শিষ্য শিবরাম দুজনে এসে উপস্থিত হন পুষ্কর তীর্থে আর এখানেই সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষিত হলেন শিবরাম। সন্ন্যাস আশ্রমে তার নতুন নামকরণ হলো গণপতি সরস্বতী। এখন পাঠকদের মনে প্রশ্ন তৈরি হবে দীক্ষিত নাম যদি গণপতি সরস্বতী হয়ে থাকে তাহলে ত্রৈলঙ্গ স্বামী নামটি কোত্থেকে এল?
আসলে তেলঙ্গ দেশ থেকে আগত সন্ন্যাসী বলে কাশির অধিবাসীরা তাকে ত্রৈলঙ্গ স্বামী বলে ডাকতেন। কাশির অধিবাসীদের ডাকা এই নামই পরবর্তীকালে তার পরিচয় হয়ে ওঠে আর মানুষ ভুলে যান তার দীক্ষিত নাম গণপতি সরস্বতীর কথা। ১৮৪৪ সালে ত্রৈলঙ্গ স্বামী ছিলেন কাশীধামে,কাশীর ঘাটে কিছু কাল বাস করবার পর পঞ্চগঙ্গার ঘাটে আশ্রম নির্মাণ করে বাস করতেন তিনি। এইসময় সর্বত্র তিনি ঘুরে বেড়াতেন উলঙ্গ অবস্থায়। এইরকম উলঙ্গভাবে ঘুরে বেড়ানো সেই সময় ছিল আইন বিরুদ্ধ। বিশেষত তাকে দেখে ইংরেজি রমণীরা লজ্জাবোধ করতেন, তাই পুলিশ তাকে কয়েকবার নিষেধ করে এইভাবে উলঙ্গ অবস্থায় না ঘুরতে, কিন্তু তাতে কিছু মাত্র কর্ণপাত করেননি সাধক পুরুষ ত্রৈলঙ্গস্বামী, ফলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে।
স্বামীজীর ভক্তরা তখন স্বামীজীর জন্য একটি উকিল ঠিক করে দেন। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে বিচার হলে স্বামীজীর উকিল বিচারককে বলেন,‘ ইনি কামনাশূন্য যোগী পুরুষ, কাজে এঁর কাপড় পরবার দরকার হয় না” বিচারপতি ত্রৈলঙ্গ স্বামীর অলৌকিক ক্রিয়া-কলাপের বিষয়ে জানতে পেরে তাকে মুক্তি দেন। এরপর ১৮৬৮ সালের শ্রীরামকৃষ্ণ কাশিতে এসে সচল শিব ত্রৈলঙ্গ স্বামীকে দর্শন করেন তার সম্পর্কে রামকৃষ্ণ ভক্তদের পরে বলেছেন,“ দেখলাম সাক্ষাৎ বিশ্বনাথ তার শরীরটা আশ্রয় করে প্রকাশিত হয়ে রয়েছেন! উঁচু জ্ঞানের অবস্থা। শরীরের কোন হুঁশই নেই। রোদে বালি এমন তেতেছে যে পা দেয় কার সাধ্য! তিনি সেই বালির ওপরে শুয়ে আছেন!”
একবার এক বিধবা স্ত্রীলোকের সাত বছরের ছেলে মারা গিয়েছিল। স্বামী নেই, একমাত্র ছেলেই ছিল তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।তার নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে সেই ছেলের জীবন প্রদীপ যখন নিভে গেল তখন মা আকুল কণ্ঠে কাঁদতে শুরু করলেন, কে তাকে বোঝাবে ? কেই বা তাকে প্রবোধ দেবে? জগতের এমন কোন সান্ত্বনা নেই যা তাকে শান্ত করতে পারে! এমন সময় সেই ভিড়ের মধ্যে প্রবেশ করলেন এক সন্ন্যাসী! মানস সরোবর থেকে সদ্য ফিরছেন তিনি! ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন মৃতদেহের সামনে! সন্ন্যাসী কে দেখে স্ত্রীলোকের মনে আশা জাগলো! মৃত সন্তানটিকে সন্ন্যাসীর পায়ের কাছে রেখে কাতর স্বরে বললেন,“ বাবা আমার এই বুকের নিধিকে তুমি বাঁচাও”। এরপর সন্ন্যাসী মৃতদেহের উপর হাত বুলালেন! কি আশ্চর্য! কিছুক্ষণের মধ্যেই বালকের দেহে খেলে গেল প্রাণের স্পন্দন! মৃত বালক চোখ মেলে উঠে তাকালো!
মা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলেন! জনতা অবাক হয়ে গেলেন! তখন সেই সন্ন্যাসীর খোঁজ পড়ল! কিন্তু সন্ন্যাসী কোথায়? কখন যে তিনি লোক চক্ষুর আড়ালে চলে গিয়েছেন তা কেউ জানেন না! এইভাবেই দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়াতেন এই সন্ন্যাসী। ইনি হলেন ত্রৈলঙ্গ স্বামী। ত্রৈলঙ্গ স্বামীর অলৌকিক কার্যকলাপ তাই মুখে বলে শেষ করা সম্ভব নয়! তিনি ছিলেন যোগীর শ্রেষ্ঠ। ২৮০ বছর তিনি জীবিত ছিলেন তার জন্ম হয় ১৬০৭ খ্রিস্টাব্দে এবং তিনি দেহ রাখেন ১৮৮৭ সালের পৌষ মাসে মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি জানতে পেরেছিলেন তার কাল পূর্ণ হয়েছে। এরপর মৃত্যু দিনে নির্দিষ্ট সময়ে ধ্যানমগ্ন হয়ে তিনি দেহ রক্ষা করেন।