একবার পুরী ধামে উলঙ্গ এক সন্ন্যাসীকে ঘিরে বেজায় ভিড়। কত লোক কত মনের বাসনা নিয়ে বাবার কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছেন, কিন্তু এতকাল এই সাধু ঠিক কোথায় ছিলেন? সাধুবাবার বয়স যে কত তাও কেউ সঠিক বলতে পারছে না!
১৯৪৯ সালে এই সন্ন্যাসী সাধুর আগমন বার্তা পুরীধামে ঝড়ের গতিতে ছড়িয়ে পড়ে আর সবাই তাকে নাঙ্গা বাবা বলে ডাকতে থাকেন, কেউ আবার বলেন, ইনি পঞ্জাবী সাধক! কিন্তু আসলে কে এই সাধু? কী তার পরিচয়?
হ্যাঁ, ইনি আর কেউ নন, ইনি হলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের দীক্ষা গুরু। যত মত তত পথের প্রবক্তা, স্বামী বিবেকানন্দের গুরু ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের বিষয়ে জানেন না এমন মানুষ নেই, কিন্তু এই অবতার পুরুষের যিনি দীক্ষাগুরু সেই তোতাপুরী সম্পর্কে কতজন জানেন? কেমনই বা ছিল রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব এবং তোতাপুরীর প্রথম সাক্ষাৎ?
তোতাপুরী যখন দক্ষিণেশ্বরে এলেন তখন তিনি মধ্যবয়সী প্রৌঢ়, তিনি মন্দির চত্বরে পৌঁছেই প্রথমে গেলেন ঘাটের কাছে, সেখানে তখন অনেকেই বসে ছিলেন, অনেকের সঙ্গে অবশ্য রামকৃষ্ণও ছিলেন। কিন্তু তাঁর সন্ধানী চোখ রামকৃষ্ণকে ঠিক খুঁজে নিল, তিনি বুঝতে পারলেন এই যুবক আর পাঁচ জনের থেকে আলাদা।
তোতাপুরী সোজা রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের কাছে এসে বললেন , “তোকে উত্তম অধিকারী মনে হচ্ছে। বেদান্ত সাধনা করবি?” শান্ত কন্ঠে রামকৃষ্ণ জবাব দিলেন,“ কী করব তার আমি কী জানি? সব জানেন মা। তিনি হ্যাঁ বললে , আমি করব” তোতাপুরী তখন বললেন,“ তবে যা, তোর মাকেই জিজ্ঞাসা করে আয়।” তোতাপুরী ভেবে ছিলেন, রামকৃষ্ণ তার মানবী মায়ের কথা বলছেন, কিন্তু তোতাপুরী অবাক হয়ে দেখলেন যে, রামকৃষ্ণ গিয়ে ঢুকলেন মা কালীর মন্দিরে আর কিছুক্ষণ পরে রামকৃষ্ণদেব বেরিয়ে এলেন ভাবে টলোমলো, বাহ্য চেতনশূন্য অবস্থায়। আনন্দে উৎপন্ন হয়ে তাকে বললেন,“ মাকে জিজ্ঞেস করলুম, মা বললেন, যা শেখ, তোকে শেখাবে বলেই তো অত দূর থেকে এসেছে।” রামকৃষ্ণের সরল নিষ্পাপ মুখ দেখে তোতাপুরী তখন মুগ্ধ।
পঞ্চবটির পূর্ব দিকের একটি চালা ঘরে রামকৃষ্ণকে দীক্ষা দিলেন তোতাপুরী, এই চালা ঘরের বর্তমান নাম ধ্যান ঘর। তিন দিন, তিন রাত বাহ্য জ্ঞান বিলুপ্ত হয়ে রামকৃষ্ণ ধ্যান করে চলেছেন, দেহে সাড়া নেই, মুখে শব্দ নেই, মুখমন্ডল দিব্যজ্যোতিতে উদ্ভাসিত, তালা খুলে ঘরে ঢুকে তোতা রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব কে এই রূপে , এইভাবে দেখে স্তম্ভিত। অবাক হওয়ারই কথা! এত তাড়াতাড়ি রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব যে এই কঠিন বিদ্যা আয়ত্ত্ব করে ফেলবেন তা বুঝতে পারেননি তিনি!
রামকৃষ্ণের উপরে দেবীর এই মায়া দেখে তোতাপুরী বলে উঠলেন, যেটি লাভ করতে আমায় কয়েক বছর কঠোর সাধনা করতে হয়েছে যুবক রামকৃষ্ণ সেটি একদিনে পেয়ে গেলেন! তবু তোতাপুরী পরীক্ষা করে দেখলেন, হ্যাঁ,হয়েছে, হৃদস্পন্দন হচ্ছে না, সত্যিকারের নির্বিকল্প। তোতাপুরী বার বার ‘হরি ওম’ মন্ত্র আবৃত্তি করতে লাগলেন, অবশেষে সমাধি থেকে রামকৃষ্ণ জেগে উঠলেন ও লুটিয়ে পড়লেন তোতাপুরীর সামনে। তোতাও শিষ্যকে দেখে মুগ্ধ হয়ে প্রেমে আপ্লুত হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলেন বুকে। ইনিই সেই তোতাপুরী যিনি শ্রীরামকৃষ্ণ কে বলেছিলেন গীতার সার,‘ গীতা ১০ বার বললে যা হয় তাই গীতার সার অর্থাৎ ত্যাগী ত্যাগী’ , রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে তিনি বলেছিলেন, “ঘটি একদিন মাজলে কী হবে- ফেলে রাখলে আবার কলঙ্ক পড়বে।”-অর্থাৎ সাধনা ভজনার মধ্যে সব সময় থাকতে হয়, দীর্ঘ সময় সাধনা করবার পর কোন এক মুহূর্ত ফাঁকি দিয়ে যদি সংসারে মন দেওয়া হয়, তাহলে সেই একই অবস্থা হয়!
পুরী তীর্থ বাসের গোড়ার দিকে নাঙ্গা বাবা থাকতেন সাগর তীরে। এক শ্মশানে সারাদিন ধ্যানস্থ থাকার পর সন্ধ্যায় একটু আগে বাবা একসের দুধ আর দুটি ডাব আহার হিসেবে গ্রহণ করতেন, মধু গোয়ালা রোজ ভক্তি ভরে বাবার পান করার জন্য এই দুধ যোগাত। গোয়ালার সঙ্গে থাকতো তার বালক পুত্র বংশীধর, রোজ একজোড়া ফুলের মালা নাঙ্গা বাবার গলায় পরিয়ে দিয়ে এসে ভক্তি ভরে প্রণাম করত বংশীধর।
মধু গোয়ালার ছেলে বংশীধর ছিল জন্ম থেকেই অন্ধ। তবে মধু গোয়ালা গরীব হলেও একমাত্র ছেলের চোখের চিকিৎসার কোনো কিছু ত্রুটি করেনি, সমস্ত জায়গায় সে চেষ্টা করেছে, কিন্তু সব চেষ্টাই তার ব্যর্থ হয়েছে। এই মধু গোয়ালা বুঝেছিল চিকিৎসক যখন হাত তুলে নেয় তখন অবতার পুরুষ এবং ঐশ্বরিক কৃপায় অলৌকিক সাধন হয়। একদিন মধু গোয়ালা তাই ছেলেকে বলে দিলো, আজ মালা দেওয়ার পর বাবাকে প্রণাম করে চোখের দৃষ্টি প্রার্থনা করবি। বংশীধর কেঁদে কেঁদে বাবার কাছে মিনতি জানালো, বাবা আমি জন্মান্ধ আপনি আমার উপর কৃপা করুন। নাঙ্গা বাবা চোখ মেলে তাকালেন, তার মনে দয়া হল, বললেন, “বাচ্চো, দেখো অভি সে তুম আন্ধা নেহি, পুরা দৃষ্টি তোমার আঁখ মে আ গিয়া” বংশীধরের দৃষ্টিও তখন খুলে গেলো, চোখের সামনে সব কিছু দেখতে পেয়ে আনন্দে চিৎকার করে উঠলো সে।
এরপর নাঙ্গা বাবা গির্ণারীর বন্তায় তাঁর আশ্রম স্থাপন করেন কিন্তু আসন বিছিয়ে কিছুদিন কোথাও অবস্থান করার পরই হঠাৎ একদিন মহাপুরুষ কোথায় অন্তর্ধান করতেন, কিছুদিন পর দেখা যেতো, কোনো বনে শ্মশানে বা সাগরতটে, যেখানে যেতেন সেখানেই আশ্চর্য ভাবে তার সঙ্গী জুটে যেতো, কিন্তু কোন সঙ্গীকে তিনি সঙ্গে রাখতে চাইতেন না, বলতেন, আমি ন্যাংটা মানুষ, কোন রকম কৃচ্ছসাধনাতেই আমার কষ্ট হয় না, তোমরা কেন আমার সঙ্গে থেকে কষ্ট করবে?
১৯২১ সালের মাঝামাঝি নাঙ্গা বাবা আবার পুরীতে ফিরে আসেন। অন্তরঙ্গ ভক্তরা খুশি হয় বাবার ফিরে আসায়। পুরীর অন্যতম জমিদার কৃষ্ণ বাবুর স্ত্রী তুলসী দেবী ছিলেন নাঙ্গা বাবার অন্যতম ভক্ত, তিনি অক্লান্তভাবে বাবার সেবা করতেন, একবার নাঙ্গা বাবা কাউকে কিছু না বলে পুরীধাম থেকে অন্তর্হিত হলেন। বাবার হঠাৎ এই অন্তর্ধানে অত্যন্ত কষ্ট পেয়ে তুলসী দেবী প্রতিজ্ঞা করলেন, যতদিন না বাবা পুরীধামে ফিরবেন, ততদিন তিনি থাকবেন উপবাসী, খুবই আশ্চর্যের কথা এই মহিলা ভক্তের অনশনব্রত চলে প্রায় দু বছর ধরে। নাঙ্গা বাবার অলৌকিক কৃপার ফলেই তা সম্ভব হয়েছিল, দুইবছর পর ভক্তরা খবর পেলেন নাঙ্গা বাবা ভাগলপুরের কাছে এক গভীর অরণ্যে তপস্যা রত অবস্থায় আছেন-তখন কৃষ্ণ বাবু ছুটে সেখানে গেলেন ও নাঙ্গা বাবাকে সব ঘটনা খুলে বললেন, সব শুনে বাবা আর একমুহুর্ত দেরী না করে ফিরে এলেন পুরী ধামের আশ্রমে। বাবা ছিলেন কৃপার সাগর, প্রচুর মানুষের কল্যাণ করেছেন তিনি, অসংখ্য মানুষকে রক্ষা করেছেন ব্যাধির থেকে, অসংখ্য ভক্তের রোগ তিনি স্বেচ্ছায় নিয়েছেন নিজের দেহে।
একবার একজন দুরারোগ্য ব্যাধিগ্রস্থকে রক্ষা করার পর বাবা বললেন, এই আমার তুণে রাখা শেষ বাণ। এরপরই নাঙ্গা বাবা কাল রোগে আক্রান্ত হলেন ও প্রায় একশো ষাট বছর জীবন যাপনের পর ১৯৬১ সালের ২৮ শে আগস্ট ইহজাগতিক লীলার অবসান ঘটিয়ে পাড়ি দিলেন অনন্ত লোকে।