শিব চতুর্দশীর পুণ্য তিথিতে শিব ঠাকুরের জন্য ভোগ নৈবেদ্য সাজিয়ে নবীনচন্দ্রের মা গিয়েছেন স্নান করতে, ছেলেকে তিনি বসিয়ে রেখে গিয়েছিলেন পাহারায়। কিন্তু স্নান সেরে এসে নবীনচন্দ্রের মা যা দেখলেন, তাতে তার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে উঠল! অগ্নিশর্মা হয়ে তিনি ছেলেকে তিরস্কার করতে শুরু করলেন। আসলে স্নান সেরে এসে নবীনচন্দ্রের মা দেখেন ইঁদুরে নৈবদ্যের সমস্ত উপচার খেতে শুরু করে দিয়েছে, অথচ তার ছেলের সেদিকে কোন হুঁশ নেই! ঠাকুরের সমস্ত ভোগ নৈবেদ্য তিনি সাজিয়ে রেখে গিয়েছেন অথচ ছেলে কেন সেটা ঠিক মতো পাহারা না দিয়ে রেখে দিয়েছে এই বলে মা যখন ছেলেকে ক্রমাগত তিরস্কার করছে তখন একটা সময় পর ছেলে অবশেষে মুখ খুলল।
মায়ের তিরস্কারের জবাবে নবীনচন্দ্র বলল, " যে ঠাকুর নিজের চাল,কলা রক্ষা করতে পারে না তাকে পুজো করে কী ফল? ভগবানকে এই কুঠুরিতে বসিয়ে চাল, কলা, ফুল, বেলপাতা দিয়ে পুজো করতে আমার মন চায় না। জলে, স্থলে, আকাশে সব জায়গায় তিনি আছেন ছড়িয়ে, আমার যে তাকে দেখতে ইচ্ছে করে মা।" ছেলের মুখে এই কথা শুনে চমকে উঠলেন মা! তার মনে পড়ে গেল ছেলের জন্মের ঠিক আগেই এক সন্ন্যাসী তার ঘরে এসে তার ছেলে সম্পর্কে এক ভবিষ্যৎবাণী করে গিয়েছিলেন, অতিথি সেই সন্ন্যাসী ভবিষ্যৎ বাণী করে বলেছিলেন, ছেলে তার সন্ন্যাসী হবে!
আজ ছেলের মুখে এই গভীর তত্ত্বকথা শুনে জন্মদাত্রীর মন সেই সংশয়ে ভরে উঠল, সত্যিই কি তবে সত্য হয়ে যাবে সন্ন্যাসীর সেই ভবিষ্যৎবাণী? ছেলে কি তবে তার সন্ন্যাসী হতে চায়? মায়ের কোল খালি করে সে কি চলে যাবে সন্ন্যাসীর পথে?
হ্যাঁ, এই নবীনচন্দ্রই ছিলেন পরবর্তীকালের পরম সাধক তিব্বতী বাবা। বর্ধমানের পালিতপুরে যার নামে তৈরি হয়েছিল 'প্রজ্ঞা মন্দির', কিন্তু এই তিব্বতী বাবার বিষয়ে আমরা কতটুকু জানি? কোথায় তার দীক্ষা? কোথায় তার সাধনা? কেমন অলৌকিক লীলা তিনি বিস্তার করেছিলেন তার চারধারে? তাই আজকে আপনাদের বলব।
পরমাত্মা যাকে টানে, সাধন পথ যাকে টানে, তাঁর হয়তো আর সংসারে থাকা হয় না! ইষ্টের সন্ধানে পরমাত্মাকে খুঁজতে তাকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হয় অনির্দিষ্টের পথে, ঠিক তেমনটাই হয়েছিল নবীনচন্দ্রের ক্ষেত্রে। নবীনচন্দ্রের বয়স তখন মাত্র ১৫ বছর, স্কুলে পড়াশোনা করে সে, একদিন হঠাৎ সে মায়ের কাছে এসে বলে," মা মানুষ কোথা থেকে আসে? কোথায় চলে যায়? এই সৃষ্টির মূলে কে রয়েছেন? সংসারের সবকিছু ছেড়ে বেরিয়ে না পড়লে আমার জীবনের এই জিজ্ঞাসার উত্তর কোনদিনও মিলবে না।"- এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই বেরিয়ে পড়েন নবীনচন্দ্র আর পরবর্তীকালে দীর্ঘ সাধনায় তিনি হয়ে ওঠেন তিব্বতী বাবা, যে বাবাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার ফলস্বরূপ দেবরোষে নিজের মৃত্যু ঢেকে এনেছিল ২৪ জন মানুষ আবার তাঁর করুণায় কবরস্থ মৃতদেহ ফিরে পেয়ে ছিল নতুন জীবন।
শ্রীহট্ট শহরের কিছু দূরের এক গন্ডগ্রামের ক্ষুদ্র জমিদার রাজচন্দ্র চক্রবর্তীর সন্তান ছিলেন নবীনচন্দ্র, নবীনচন্দ্রের জন্ম আনুমানিক ১৮২০ সালে, জমিদার পুত্র হওয়ায় ছোট থেকে ঐশ্বর্যের মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি, সংসারে কোন অভাব অনটন ছিলো না তাঁর, ছিলো না কোনো অযত্ন তবুও এক অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সকল মোহ মায়া কাটিয়ে জীবনের পরম সম্পদকে লাভ করতে নবীনচন্দ্র বেরিয়ে পড়েন পথে।
দীনদয়াল উপাধ্যায় ছিলেন গয়ার একজন বিখ্যাত কবিরাজ ও শাস্ত্রবিদ পন্ডিত, নবীনচন্দ্র ৩ বছর উপাধ্যায়ের গৃহে বাস করেন দর্শন ও বৈদ্য শাস্ত্রে মোটামুটি ভালই জ্ঞান অর্জন করেন তিনি , এরপর তিনি ঠিক করেন যে,বৈদ্য শাস্ত্রের সাহায্যে জীবিকার পথ সন্ধান করবেন তিনি কিন্তু হঠাৎ তার মনে আত্ম চেতনা জেগে ওঠে এরপর সেই বন্ধন ছিন্ন করে তিনি বারানসীতে চলে যান। সেখানে তাঁর একজন সঙ্গী জুটলো, সেই সঙ্গীকে নিয়ে তিনি উপস্থিত হলেন তান্ত্রিক এক সন্ন্যাসীর কাছে। কিন্তু সেই জায়গাটি ছিলো তাদের জন্য চূড়ান্ত ভুল একটি নির্বাচন, সেখানে গিয়ে তাঁরা বুঝতে পারেন, তান্ত্রিক কাপালিক তাদেরকেই বলি দেবার চক্রান্ত করছেন। সময় সুযোগ মতো বন্ধুকে নিয়ে নবীনচন্দ্র সেখান থেকে পালিয়ে গেলেন।
এরপর বৃন্দাবনে কিছুকাল কাটিয়ে নবীনচন্দ্র শুরু করলেন তীর্থে তীর্থে ভ্রমণ। কুরুক্ষেত্র, পুষ্কর, জ্বালামুখী প্রভৃতি পর্যটন শেষ করে উপস্থিত হলেন কাশ্মীরের প্রসিদ্ধ তুষার তীর্থ অমরনাথে,সেখান থেকে ফেরার পথে এক শক্তিধর যোগীর সঙ্গে তাঁর দেখা হল। যোগীবর তাকে নিজের কাছে রেখে যোগ সাধনার অনেকগুলি প্রক্রিয়া দেখিয়ে দিলেন। কিছুদিন পরে যোগী বললেন,"আমি তোমার গুরু নই। তোমার গুরু রয়েছে তিব্বতে। তুমি সেখানে যাও, তবে তিব্বতে ঢোকা বড় কঠিন, বড় বিপদজনক। তুমি প্রথমে নেপালে যাও, সেখানকার প্রধানমন্ত্রী আমার ভক্ত। আমার নাম করলে সে তোমার তিব্বতে যাবার ব্যবস্থা করে দেবে।" এরপর নেপালের প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতায় নবীনচন্দ্র তিব্বতে গিয়ে উপস্থিত হলেন অনেক খোঁজাখুঁজির পর জানতে পারলেন পাহাড়ের কোলে ভরতগুহায় শৈব তান্ত্রিক এক প্রাচীন শক্তিমান সাধক থাকেন, নবীনচন্দ্র দুর্গম চড়াই পেরিয়ে সেই গুহায় উপস্থিত হলেন, পরমানন্দ ঠক্কর নামে সেই সাধক ছিলেন পরিচিত। যোগবল ও তান্ত্রিক সিদ্ধাইয়ের অধিকারী ছিলেন তিনি, দিব্যশক্তির সাহায্যে তিনি কয়েকশো বছর ধরে বেঁচে আছেন, এই ঠক্কর বাবার কাছেই নবীনচন্দ্র দীক্ষা লাভ করেন ও দীর্ঘকাল কঠোর সাধনার পর যোগ ও তন্ত্রে তিনি করেন সিদ্ধি লাভ এরপর তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন তিব্বতী বাবা নামে।
দীক্ষা লাভ করার পর ৩২ বছর তিনি তিব্বতে ছিলেন তিব্বত বাসের শেষ সাতটি বছর এই মহাপুরুষ ধ্যানের গভীরে সমাহিত হয়ে যান, কখনো বরফমন্ডিত গিরি গুহায় কখনো খরস্রোতা নির্ঝরিণীর ধারে, কখনো সর্প ব্যাঘ্র সংকুল গভীর অরণ্যে, দিনের পর দিন অতিবাহিত করতেন সমাধিস্থ অবস্থায়। শক্তিমান লামা এবং বৌদ্ধ তান্ত্রিকেরা তার সংস্পর্শে আসেন এবং তিনি তাঁদের কাছ থেকে সাধনার বহু নিগূঢ় ক্রিয়া শিক্ষা করেন। এরপর তিব্বতী বাবা পৃথিবীর নানা স্থান পরিক্রমায় বের হন, কৈলাসের অধীনস্থ চ্যাং-টাং অঞ্চল থেকে তার পদযাত্রা শুরু হয়। উত্তর সাইবেরিয়া পেরিয়ে তিনি পূর্ব চীনে আসেন। চীন,মঙ্গোলিয়া ও সাইবেরিয়া ভ্রমণের মধ্য দিয়ে তিব্বতী বাবা প্রায় ছয় হাজার মাইল পথ অতিক্রম করেন! কীভাবে এই দুর্গম পথ তিনি অতিক্রম করেছিলেন এবং কীভাবে নিজের ভরণ পোষণ করেছিলেন তা ভাবলে সত্যি আশ্চর্য হতে হয় আজকে।
হিমালয়ের গুহাকন্দরে সুদীর্ঘ তপস্যা সমাপ্ত করে তিব্বতী বাবা নেমে আসেন লোকালয়ে, মাথায় তখন তাঁর রুক্ষ জটা, তিনি পরে আছেন গৈরিক বসন।
এইসময় এক সরাইখানায় তাকে দেখে দুটি লোক তাচ্ছিল্য করে ও থুতু দেয় তিব্বতী বাবা কিন্তু এই ঘটনায় পুরো নির্বিকার কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই লোক দুটি ছটফট করতে করতে মরে গেল। এরপর উত্তরপ্রদেশের এক চটিতে গিয়েছেন তিনি, ২২ জন লোক তাকে দেখে উপহাস করে থুতু ছেটায় ও গলায় পরিয়ে দেয় চটি , জুতোর মালা। তিব্বতী বাবা তাদের কিছু না বলে ধ্যানস্থ হলেন ও কিছুক্ষণ পর দেখা গেলো ২২ জন লোকই মরে পড়ে আছে। সবশুদ্ধ চব্বিশটি মানুষ অকালে প্রাণ হারায় এইভাবে, তিব্বতী বাবার অন্তর অনুতাপ ভরে গেল।
পরদিন সকালে ঘটল আরও এক অলৌকিক ঘটনা।
এক মুসলমান তার একমাত্র সন্তান দশ বছরের ছেলেকে কবর দিয়ে গেছে, গোরস্থান থেকে সবাই যখন ফিরে গেলো, তিব্বতী বাবা তখন কবরের মাটি সরিয়ে মৃতদেহটি তুলে আনলেন ও তারপর তার সামনে স্থির হয়ে বসে কিছুক্রিয়াদি শুরু করলেন এবং ছেলেটি ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল। ছেলেটিকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে আবার পর্যটনে বেরিয়ে পড়লেন তিব্বতী বাবা। তিব্বতী বাবা নিজের সম্পর্কে বলে ছিলেন,
"আমি হব একাধারে বৌদ্ধ ও বৈদান্তিক। বৌদ্ধের বোধি হয়ে উঠবে তাঁর কাছে বৈদান্তিকের পরমজ্ঞান যা তাঁকে নিয়ে যাবে ব্রহ্ম উপলব্ধির গভীরে। বৌদ্ধদের বিশ্বাত্মাবাদ ব্রহ্ম উপলব্ধির এক বিশুদ্ধ নির্যাস ছাড়া আর কিছুই নয়।"
বর্ধমানের পালিতপুরে কয়েকজন ভক্ত তিব্বতী বাবার নামে একটি আশ্রম তৈরি করেন, তার নাম প্রজ্ঞা মন্দির। ১৯৩০ সালের ১৮ই নভেম্বর ১৮২ বছর জীবন যাপন করে প্রজ্ঞামন্দিরেই এই মহাসাধক চিরনির্বাণ লাভ করেছিলেন।