গৃহী থেকে ভগবানের ভক্ত হয়ে উঠে ছিলেন সাধক তুকারাম আর তার স্পর্শে শস্য শূণ্য ক্ষেত হয়ে উঠেছিল শস্যময়, ব্যবসায়িক বুদ্ধি ভালো ছিল না বলে যাকে দিনরাত কথা শুনতে হতো, তিনি তার সাধনার মধ্য দিয়ে পেয়েছিলেন তার আরাধ্য দেবতাকে! সেই কারণেই তো তাকে দেখতে সব ছেড়ে দিয়ে ছুটে এসেছিলেন মারাঠা নায়ক শিবাজী! তুকারামের মধ্যে তিনি দেখেছিলেন এক অলৌকিক জ্যোতি, জ্ঞানের স্ফুলিঙ্গ, বিবেক বৈরাগ্যের মিলন! কে এই তুকারাম? কী ছিল তার গল্প? বলবো আজকে।
সাধু তুকারামের প্রাণের দেবতা বিঠোদেব। দিনরাত পাথরের সেই বিষ্ণু মূর্তিকে নিয়ে তিনি পড়ে থাকেন,তাঁর নিত্য সেবা করেন। কিন্তু তার মুখরা স্ত্রী জিজাবাঈ, এইগুলো একদমই পছন্দ করেন না। একদিন স্পষ্টভাবেই জিজাবাঈ তুকারামকে বলে বসলেন যে,"হয় বিঠোদেবকে ছাড়ো, না হয় আমি সংসার ছেড়ে চলে যাবো।" তুকারাম বড় বিপদে পড়লেন,বিঠোদেবকে তিনি কী করে ছাড়বেন? তাকে ছেড়ে কীভাবে থাকবেন? বিঠোদেবই যে তার প্রাণেশ্বর!
অন্যদিকে সংসারেও অশান্তি, তাই সব দিক চিন্তা করে সাধু তুকারাম বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
তুকারাম বাড়ি তো ছাড়লেন, কিন্তু থাকবেন কোথায়? পাহাড়ের এক নির্জন প্রান্তে থাকতে শুরু করলেন তিনি, সারাদিন সেই পাহাড়ের নির্জন প্রান্তে কাটিয়ে ফিরে আসতেন তিনি সন্ধ্যের পরে,দেহলীতে এক কৃষকের জমি ছিলো, একদিন সেই চাষী তুকারামকে দেখতে পেয়ে বললো," তুকা তুমি তো এখানে বসে নিষ্কর্মা হয়েই দিন কাটাচ্ছো, আমার ক্ষেতের শস্যগুলো তুমি পাহারা দাও না, এজন্য কিছু অবশ্য তুমি পাবে।"
তুকরাম রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু পাহারা দেবেন কি? পাখির দল যখন শস্যের ওপর উড়ে এসে বসে,তখন তার মন গলে যায়,ভাবেন,"আহা সৃষ্টিকর্তা তো পৃথিবীর বুকে শস্য ঢেলে দিচ্ছেন তার সৃষ্ট সকল জীবের জন্য, তবে পাখি বেচারারা কেন অনাহারে মরবে?" তিনি আর পাখি তাড়াতে পারেন না এই ভেবে।
একদিন কয়েকটি গরু এসে ক্ষেতের শস্য একবারে উজাড় করে ফেললো, চাষি তো দেখে গ্রামের পাঁচজনকে ডেকে আনলো তুকারামের বিচার করার জন্য, কিন্তু বিচার করতে এসে সবাই একদম অবাক হয়ে গেলো!!! কার বিচার করবে? সারা ক্ষেত শস্যে ভরে আছে। সেদিন থেকে লোকে বুঝতে পারলো
তুকারাম কোনো সাধারণ মানুষ নয়।
এই তুকারাম জন্মগ্রহণ করেন আনুমানিক ১৫৮৮ খ্রিস্টাব্দে দেহলি নামক গ্রামে। মাতা কনকাবাঈ এর দ্বিতীয় পুত্র তিনি। তার বড় ভাই সাওজি ছিলেন সংসারের প্রতি উদাসীন,মা-বাবার মৃত্যুর পর তিনি সন্ন্যাসী হয়ে ঘর ছাড়েন,এরপর সংসারে দুর্যোগ ঘনিয়ে আসে। তুকারামের উপর সমস্ত সংসারের ভার পড়ে, ব্যবসা দেখাশোনার ভার পড়ে, কিন্তু যার মন ভগবানে নিবিষ্ট, দিনরাত ইষ্ট চিন্তা ছাড়া যিনি আর কিছু ভাবতে পারেন না বৈষয়িক বুদ্ধি দ্বারা আসবে কোত্থেকে?অচিরেই সেই ব্যবসা তাই নষ্ট হয়ে গেলো।
তুকারাম বহু মারাঠি পদ রচনা করেছেন, যেখানে স্ত্রীর গঞ্জনার কথা উল্লেখ করেছেন, আর একটি পদে তিনি পারিবারিক কলহের কথা তুলে ধরেছেন। স্ত্রীর গঞ্জনার জন্য তুকারাম প্রায়ই ঘরে থাকতেন না, দেহলির কাছে এক পাহাড়ের নির্জন অরণ্যে ধ্যানে বিভোর হয়ে থাকতেন, ধীরে ধীরে তুকারামের মধ্যে সাধকের অলৌকিক শক্তি গুলি প্রকাশ পেতে থাকে, ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় প্রভৃতি উচ্চ বর্ণের অনেক ভক্ত হয়ে পড়ে তার। এই সময় সেখানকার এক প্রতিপত্তিশালী মোহান্ত তুকারামের ওপর রেগে যান। কোন সাহসে শূদ্র হয়ে সে ব্রাহ্মণকে শিষ্য করে? এই ভেবে সে তুকারামকে শাস্তি দিতে একদিন কাটা গাছের ডাল দিয়ে তুকারামকে আক্রমণ করে, আঘাতের পর আঘাতে তুকার পিঠ থেকে রক্ত পড়তে শুরু করে।
ঐ মোহান্ত কিন্তু তুকারামের হরি কীর্তনের আসরে রোজ আসতেন কিন্তু সেদিন সেখানে তিনি উপস্থিত হলেন না, তাই রাত্রে সেই মহান্তর ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলেন তুকারাম। গিয়ে দেখলেন ব্যথায় বিছানায় পড়ে কাতরাচ্ছেন সেই মোহান্ত, তুকারাম তখন বললেন," গোঁসাই দোষ আমারই। বহুক্ষণ ধরে আমাকে প্রহার করে আপনাকে শ্রান্ত হতে হয়েছে তাই তো আপনার শরীরে এরকম ব্যথা হয়েছে। আমার জন্যই আপনার কষ্ট" এরপর সেই মোহান্তর গায়ে তুকা হাত বুলিয়ে দিতেই তার ব্যাথা মুহূর্তের মধ্যেই দূর হয়ে গেলো, এই দেখে মোহান্ত বুঝতে পারলেন তুকার মহিমা!! কেঁদে তিনি তুকাকে বললেন," তুমি ভক্ত তুমি মহৎ! তুমি আলোর সন্ধান পেয়েছো, আমাকে আলো দেখাও ভাই"- ঐ মোহান্তের সেদিন শুধু স্বভাবই পরিবর্তন হয় নি, তিনি যেন লোহা থেকে সোনা হয়ে উঠে ছিলেন পরশমনির স্পর্শে!!! এরপর তুকারামের খ্যাতি আরো ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে, তার সেই খ্যাতির কথা শুনে মারাঠা নায়ক শিবাজী পর্যন্ত ছুটে এসেছিলেন তার কাছে, তার চরণ তলে আশ্রয় নিয়ে ভুলেছিলেন রাজপাঠ আবার তুকারামের পরামর্শেই তিনি ফিরে গিয়েছিলেন রাজ্যে,তার রাজ্য পাঠ সামলাতে। মহান এই সাধক বৈরাগ্যময় জীবনের প্রতিমূর্তি স্বরূপ তুকারাম ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে পরলোক গমন করেন।