রাম নাম যে করে সেই হয় মহৎ, এই রাম নাম করেই রত্নাকর দস্যুবৃত্তি ছেড়ে হয়ে উঠেছিলেন ঋষি বাল্মিকী, এই রাম নাম করেই এক ব্রাহ্মণ বাড়ির ছোট্ট ছেলে হয়ে ওঠেন রামদাস কাঠিয়া বাবা। তার নাম অনেকেই শুনেছেন, কারণ তিনি ভারত বিখ্যাত একজন মহাপুরুষ, কিন্তু ব্রাহ্মণ বাড়ির এক ছোট্ট ছেলে থেকে কীভাবে রাতারাতি তিনি সন্ন্যাস ধর্মে অনুপ্রাণিত হলেন কীভাবেই বা তার অলৌকিক লীলা গাঁথা ছড়িয়ে পড়ল ভারতবর্ষময়, তা অনেকেরই অজানা। আজকে সেই অজানা গল্পই বলব আপনাদের।
পূর্ব পাঞ্জাবের লোনাচামারী গ্রামের এক সম্মানিত ব্রাহ্মণ বাড়ির ছেলে রামদাস,তার গ্রামের পাশেই পরমহংসশ্রেণীর এক সন্ন্যাসী থাকতেন, তার কাছে প্রতিদিন প্রচুর মানুষ আসতেন ভিড় করে ও সবাই নতমস্তকে তাকে প্রণাম করতেন। রামদাস সেই সব দেখতেন, একদিন রামদাস সেই সন্ন্যাসীর কাছে চলে গেলেন ও তাকে প্রণাম করে জিজ্ঞেস করলেন,“ মহারাজ জি আপনার কাছে এসে সবাই মাথা নোয়ায় কেন? আপনি কী করে এত বড় হলেন?” পরমহংস জি তখন হেসে জবাব দেন, “ব্যাটা আমি যে সদাই রাম নাম করি। ওই নামই আমাকে ছোট থেকে বড় করেছে। তুমিও ওই নাম জপ করো, আমার মতো হতে পারবে।”
সেই দিন থেকে রাম নাম ই রামদাসের জপের মালা হয়ে ওঠে , এরপর রামদাসের বাবা আড়ম্বরের সাথে পুত্রের পৈতে দেন ও শাস্ত্র শিক্ষার জন্য বালককে আচার্যের কাছে পাঠান, এরপর উপযুক্ত সময় এলে ছেলের বিয়ে দেওয়ার জন্য রামদাসের বাবা যখন ব্যস্ত হয়ে ওঠেন, তখন রামদাস বাবাকে পরিষ্কার বলে দেয় যে,তার বাবা যেন তার ছোট ভাইয়ের বিয়ে দিয়ে দেয়, সে সংসার করুক কিন্তু সংসার ধর্ম তার জন্য নয়।
এরপর গ্রামের সীমানায় থাকা একটি বট গাছের নীচে রামদাস আসন পেতে বসে পড়েন ও সেখানে এক লক্ষ বার গায়ত্রী মন্ত্র জপ করেন তিনি, এক লক্ষ বার গায়ত্রী মন্ত্র জপ করবার পর অবশেষে তিনি দৈব বাণী শুনতে পান যে, বৎস অবশিষ্ট ২৫ হাজার জপ তুমি জাগ্রত মহাতীর্থ জ্বালামুখীতে গিয়ে সম্পন্ন করো।
এই নির্দেশ পাওয়ার পর রামদাস জ্বালামুখীর দিকে এগোলেন। কিন্তু পথেই তার জটাধারী দিব্য কান্তি এক সন্ন্যাসীর সাথে দেখা হল। এই সন্ন্যাসীর সাথে দেখা হওয়ার পর রামদাসের মনে হলো, এই সন্ন্যাসী যেন তার কত কালের পরিচিত এরপর জ্বালামুখীতে আর যাওয়া হল না রামদাসের,সেই সন্ন্যাসীর থেকেই সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষা নিলেন রামদাস। এই সন্ন্যাসীই হলেন তার গুরুদেব। রামদাসের গুরুদেব কখনোই চান নি, রাম দাস তার লক্ষ্য থেকে ভ্রষ্ট হন,তাই বিলাস বা আরামের কারণে যাতে রামদাসের তপস্যায় বিঘ্ন না হয়, সেজন্য গুরু জি তার কোমরে ভারী কাঠের একটি আড় বন্ধ বেঁধে দিয়েছিলেন, তার সঙ্গে ঝোলানো থাকতো একটি কাঠের লেঙটি। এইসব পরে রামদাস কে চলতে , বসতে ও শুতে হতো। তার খুব অসুবিধা হতো কিন্তু কোন উপায় ছিল না! এই কাঠের লেঙটির জন্যই তার উপাধি হয়ে গিয়েছিল কাঠিয়া বাবা।
এরপর রামদাসের গুরুজির দেহান্তর ঘটলে রামদাসের সাধনার তীব্রতা আরো বেড়ে যায়। প্রবল শীতে বরফ গলা জলে ডুবে তিনি রাম নাম করতেন, তারপর দিন সকালে শিষ্যরা জল থেকে তুলে আগুনের তাপ দিয়ে তার দেহে চেতনা ফিরিয়ে আনত। এইভাবেই যোগসিদ্ধির জন্য রামদাস কাঠিয়া বাবার নাম চারিদিকে ছড়িয়ে গেল।
একজন সন্ন্যাসী একবার রামদাস বাবার যোগ শক্তি দেখে তার প্রতি প্রবল ঈর্ষান্বিত হয়ে রামদাস বাবাকে জীবন্ত অবস্থায় পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা করেন। গ্রামের প্রান্তে ভর দুপুরে ধুনী জ্বালিয়ে যখন রামদাস বাবা ধ্যান করছিলেন তখন ভন্ড সাধু টি তার চারদিকে ঘুটে সাজিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় তাতে,আর এরপর দাও দাও করে যখন আগুনের লেলিহান শিখা উর্ধ্বমুখী হয়ে চারিদিকে উঠছে, চারপাশের লোকেরা ও ভক্ত জন তখন আগুন দেখে ছুটে আসে। লেলিহান এই আগুনের শিখা দেখে সকলে ভাবতে শুরু করে যে,রামদাস বাবা নিশ্চয়ই আগুনে ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছেন, কিন্তু আগুন নিভবার পর দেখা গেল যে, কাঠিয়া বাবা অক্ষত দেহে যোগাসনে বসে আছেন ধ্যান মগ্ন হয়ে।
বৃন্দাবনের যমুনার তীরে বাবার একটি আশ্রম ছিলো, সেখানে অগণিত ভক্ত তার দর্শন করতে আসতেন, অনেকেই মনে করতেন আশ্রমে প্রচুর গুপ্তধন আছে, তাই অনেকবার তাকে মেরে ফেলবার চক্রান্ত করা হয়েছিলো। আশ্রমের রাঁধুনী পুষ্কর দাস মনে করেছিলেন যে কাঠিয়া বাবাজির কোমরে কাঠের আড় বন্ধের মধ্যে সঞ্চিত ধন লুকিয়ে আছে,তাই তাকে হত্যা করার জন্য বাবার খাবারে তিনি অনেক পরিমাণে আর্সেনিক বিষ মিশিয়ে দেন। এই তীব্র বিষের জ্বালায় কাঠিয়া বাবাজি মাটিতে পড়ে গেলেন ও মাথায় গুরুতর আঘাত লাগলো এবং পাকস্থলীতে দেখা দিল ভয়ানক গোলযোগ, পেট ফেঁপে উঠবার ফলে কাঠিয়া বাবা কোমরে কাঠের আড় বন্ধের চাপ আর নিতে পারছিলেন না। ভক্তরা তখন তার অনুমতি দিয়ে করাত দিয়ে ওই আড়বন্ধটি কেটে ফেলে দেন কিন্তু তার মধ্যে কোন গুপ্তধন না থাকায় পুষ্কর দাস ভয়ানক হতাশ হয়ে পড়েন। এর কিছুদিন পর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন বাবাজি।
এরপর ১৩১৬ সনের ৮ মাঘ প্রচন্ড শীতের এক মধ্যরাত্রিতে উঠে একবার জল চান বাবা, এরপর জল খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েন এবং সেই নিদ্রায় হয় তার জন্য শেষ নিদ্রা।