এক সংসারী মেয়ের সাধিকা পরমেশ্বরী বাঈ হ‌ওয়ার গল্প

ভাগ্য অনেক সময় মানুষকে কাঁদায়, সংসারের মোহ মায়া ভুলিয়ে মহৎ লোকে নিয়ে যাওয়ার জন্য, ঠিক যেমনটা হয়েছিল মীরাবাঈ-এর ক্ষেত্রে, শোক-দুঃখ তার জীবনে এসেছিল সংসারে বন্ধন কাটানোর জন্যই, সেই কারণেই ক্ষুদ্র সংসারের গণ্ডি ছেড়ে তিনি বেরিয়ে যেতে পেরেছিলেন মহৎ লোকে, সীমার থেকে ছুটে গিয়েছিলেন অসীমের দিকে, ঠিক এমনটাই হয়েছিলো অপর সিদ্ধা তপস্বিনী পরমেশ্বরী বাঈ এর জীবনে, নিজের অসীম দুঃখ কষ্ট,শোকের বিনিময়েই যিনি হয়ে উঠেছিলেন কৃষ্ণ সাধিকা। কেমন ছিল সেই সাধিকার জীবন,তাই জানব আজকে।

বিধবা কন্যা পরমাসুন্দরী মালতীর বিয়ে হয়ে ছিল কলকাতার ধনী এক পরিবারে। বিয়ের বেশ কিছুদিন পরেই জন্মে ছিল এক পুত্র সন্তান, কিন্তু ভগবানের কৃপা কিঞ্চিৎ বিপ্রতীপ ভাবেই পড়েছিল মালতীর ওপর। একের পর এক শোক নেমে এসে ছিল তার জীবনে, ভাগ্য তাকে ধনী পরিবারের সুখী গৃহকোণ থেকে বের করে এনেছিল, করে দিয়েছিল নিঃসঙ্গ। প্রথমে প্লেগের আক্রমণে তার স্বামী আর শ্বশুর মারা যায়, এরপর একমাত্র শিশু পুত্রকে নিয়ে মালতী অসহায় হয়ে পড়ে।

শ্বশুরের অগাধ সম্পত্তির একমাত্র মালিক হ‌ওয়ায় মালতির ওপর  তার দুঃসম্পর্কের এক ভাসুরের কোপ দৃষ্টি পড়ে। মালতীর মদ্যপায়ী পাপাচারী ভাসুর বিধবা মালতির সম্পত্তি গ্রাস করে তাকেও ভোগ করতে চায়। সেই কারণে প্রথমে সেই ভাসুর মালতির শিশু পুত্রকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলে এরপর মালতির রূপ লাবণ্যের দিকে হাতছানি দেয় সে। রাগে,ঘৃণায়, ভয়ে অস্থির হয়ে ওঠে মালতি, কী করবে সে? এত রূপ লাবণ্য নিয়ে এত অল্প বয়সে বিধবা নিঃসহায় হয়ে কার কাছে আশ্রয় নেবে মালতী? সে তখন ঘরে তার রাধা মাধবের বিগ্রহের কাছে বসে কাতর প্রার্থনা জানাতে থাকে, তার এই বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। এইবার ইষ্ট দেবতা তাকে পথ দেখান।

এক রাত্রিতে এক অলৌকিক কান্ড ঘটে, অন্ধকারের মধ্যে থেকে এক দিব্য দর্শন জটাধারী বৈষ্ণব জানলার ওপারে দাঁড়িয়ে তাকে অভয় দিয়ে বলেন যে, “রাধামাধব কৃপা করেছেন তোকে, মনের সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে চলে আয় বৃন্দাবন ধামে, তোর দুর্ভাগিনী জীবনের অবসান ঘটবে।” এই কথা বলেই উধাও হয়ে যায় ঐ সাধু মূর্তি। দৈববাণীতে ঐ আদেশ পেয়ে অকূলে যেন কূল পেল মালতি‌। বাড়ির অ্যাটর্নিকে ডেকে সেইদিন‌ই ট্রাস্ট দলিল সম্পাদন করে সমস্ত সম্পত্তি লিখে দেয় রাধামাধব জীউর নামে। লক্ষাধিক টাকা থেকে বহু মূল্যের হিরা, মুক্তা, সোনার অলংকার বিক্রি করে দিয়ে সমস্ত অর্থ জমা করে দেয় ভগবানের তহবিলে। তারপর কর্মচারীদেরকে বিদায় জানিয়ে এক কাপড়ে রেল গাড়িতে চেপে চলে আসে মথুরায়, সেখান থেকে বৃন্দাবনে দামোদর দাসজির আখড়ায়! সেখানে গিয়ে বাবাজিকে দেখে তিনি অবাক হয়ে যান এই বাবাজি যে তাকে দিব্যরূপে দর্শন দিয়েছিলেন অথচ সেখানে সেবকরা জানান, বাবাজি গত ৪০ বছর ধরে বৃন্দাবন ধাম ছেড়ে কোথাও যাননি।

ভগবানের দিব্য লীলার কথা বুঝতে পেরে দামোদর দাস বাবাজির চরণেই আশ্রয় চান তিনি, বাবাজি তাকে বলেন, “তোমার এত রূপ এই সন্ন্যাসীর আশ্রমে আমি তোমায় রাখবো কেমন করে? যদি পারো তোমার দেহ তোমার সৌন্দর্য সবকিছু শ্রীকৃষ্ণের পায়ে সমর্পণ করতে, নিজের বলে কিছুই থাকবে না, তাহলেই নটোবর কুঞ্জে তুমি আশ্রয় পাবে মা।” -দামোদর দাস বাবাজির কথা শুনে সেদিন রাজি হন মালতি, সাধন পথে অগ্রসর হন তিনি আর মালতিকে ধীরে ধীরে পরিশুদ্ধ করে তোলেন দামোদর দাস বাবাজি।

নটোবরজির বিগ্রহের ঐকান্তিক সেবায় নিজেকে ঢেলে দেয় মালতি। নতুন নামকরণ হয় তার কুঞ্জদাসী। চরম কৃচ্ছসাধন ত্যাগ ও বৈরাগ্যের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় কুঞ্জদাসী।  সন্তুষ্ট হয়ে বাবাজি বলেন,“ কৃষ্ণভাবনায় তুই একেবারে ডুবে গেছিস, এই আশ্রমে আর তোর থাকবার প্রয়োজন নেই, এবার তোর অরণ্য বাস। আরো তীব্র বৈরাগ্য আরো চরম সাধনা কর, ঠাকুর নটোবরজির নির্দেশেই তোকে আমি বলছি, বৃন্দাবন আর গোবর্ধন গিরির মাঝখানে যে বন আছে সেখানে ঝুপড়ি বেঁধে তোকে সাধন ভজন করতে হবে, কোন ভয় নেই, তুই একেবারে খাঁটি সোনা।”

কুঞ্জদাসীকে বৈষ্ণব ও সন্ন্যাসের ধর্মে দীক্ষিত করলেন দামোদর দাস বাবাজি। তার নতুন নামকরণ হলো পরমেশ্বরী দাসী,তখন তার বয়স ৩০ বছর মাত্র, ইনিই ভক্তদের কাছে পরবর্তীতে পরিচিত হয়েছিলেন সিদ্ধা পরমেশ্বরী বাঈ রূপে। বিহারবনের অভ্যন্তরে লতাপাতার কুটির বেঁধে পরমেশ্বরী শুরু করেন চরম কৃচ্ছ সাধন ও তপস্যা। গ্রামের গরীব কাঠুরে ভিখনলাল তার প্রথম ভক্ত, ক্রমে অন্যান্য গ্রামবাসীরা ও তার ভক্ত হয়ে আনাগোনা শুরু করে বিহারবনের ঝুপড়িতে। এইভাবে কাটলো আরো দশ বছর।

একদিন গুরু দামোদর দাস বাবাজি তার কাছে এসে বললেন,“ মা তুই প্রেমসিদ্ধা হয়েছিস, লীলাময়ের অপার প্রেমলীলা আস্বাদন করার সৌভাগ্য হয়েছে তোর। এবার আমাকে বিদায় দে। এখন বৃন্দাবন তোর। আমাকে বিদায় দে। এখন বৃন্দাবনে ফিরে নটোবর জির পায়ে এ দেহের খোলা টিকে ফেলে দেবো।” এরপর গুরু দামোদর দাস বাবাজি তার ইহজগতের লীলা শেষ করে বৈকুণ্ঠ লোকে পাড়ি দেন। এরপর ভক্তদের কাছে পরমেশ্বরী বাঈ হয়ে ওঠেন  পরম সিদ্ধা যোগী, তাকে ভগবানের অবতার জ্ঞান করে সকলে দর্শন করতে আসেন পূণ্য সঞ্চয় করার অভিলাষে।

একবার পরম সিদ্ধা এই পরমেশ্বরী বাঈকে বাহ্যিক লোলুপ দৃষ্টিতে দেখার জন্য এক সাহেব  পেয়েছিলেন চরম শাস্তি। বন জঙ্গলের মধ্যে মহান এই সাধিকাকে দেখেই সাহেব কু অভিসন্ধি করেছিলেন, নিজের তাবুতে তাকে রাতে নিয়ে আসবেন ভেবেছিলেন, গ্রাম প্রধান সে কথা জানতে পেরে নিজে তো রাজি হন নি, বরং সাহেবকে সাবধান করে দেন, সন্ধ্যের পর সিদ্ধাবাঈ এর ভজন কুটিরের চারিদিকে যে গন্ডি আঁকা আছে সেটা পেরিয়ে ঢুকবার চেষ্টা যেন না করেন সাহেব, তাহলে তার ভয়ঙ্কর বিপদ হবে। কিন্তু  আগুনের মধ্যে পিঁপড়ের ছুটে যাওয়ার মতো সেই সতর্কবাণী অগ্রাহ্য করে উন্মাদের মতো সাহেব ছুটে যেতে থাকেন পরমেশ্বরী বাঈয়ের ঝুপড়ির দিকে।

এরপর দম্ভ সহকারে যখন সেই আঁকা গণ্ডি পেরিয়ে তিনি ঢুকতে যাবেন,তখন তিনি বুঝতে পারেন এক অদৃশ্য শক্তি প্রচন্ড আঘাতে তাকে ধরাশায়ী করে দেয়। এরপর আবার উঠে দাঁড়াতে গেলে আবার‌ও এক অদৃশ্য শক্তি তাকে শূন্যে তুলে আছড়ে ফেলে দেয় মাটিতে। কয়েক ঘন্টা সেখানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকার পর নিজের ভুল বুঝতে পেরে নিজের গর্হিত আচরণের জন্য পরমেশ্বরী বাঈ-এর কাছে ক্ষমা চান তিনি আর এই মহাসাধিকা ১৯১০ সালের শেষভাগে চলে যান অমরলোকে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...