উত্তর ভারতে পওহারী বাবার নাম শোনেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না, কারণ উত্তর ভারতের সাধক সমাজে এই মহৎ আত্মার প্রচুর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে, যে খ্যাতির কথা শুনেই স্বামী বিবেকানন্দ পর্যন্ত ছুটে এসেছিলেন এই মহাপুরুষের চরণ তলে! কিন্তু এই পওহারী বাবার জীবন বৃত্তান্ত অনেকেই জানেন না! আজ এই সাধক পুরুষের জীবন বৃত্তান্তই আপনাদের বলব।
১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে জৌনপুর জেলার প্রেমাপুর গ্রামে ভক্তিমান ও নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব অযোধ্যা তেওয়ারীর ঘরে জন্ম হয় হরভজনের। শৈশবে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে হরভজনের ডান চোখ নষ্ট হয়ে যায়, তখন তার পিতৃব্য বৈষ্ণব সাধক লছমীনারায়ণ বলে ছিলেন যে,“অযোধ্যা দুঃখ করো না, দেখি নিও, তোমার এই ছেলে একদিন লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়ের রাজা হবে, সম্মান পাবে।” মাত্র ১০ বছর বয়সে মায়ের সান্নিধ্য হারিয়ে হরভজন এরপর চলে আসেন লছমীনারায়ণের আশ্রমে। সেখানেই তার দিন কাটতে থাকে, তার বয়স যখন ১৬ বছর ঠিক তখনই লছমী নারায়ণের মৃত্যু হয়। এই মৃত্যু দেখেই হরভজনের মনের মধ্যে তীব্র বৈরাগ্য জাগে এবং তিনি তীর্থের পথে পথে বেরিয়ে পড়েন।
অনেক তীর্থ ঘুরে বহু বিগ্রহ এবং সাধুসন্তের দর্শন করেও তার মনে তৃপ্তি হয় না, সৎ গুরুর আশ্রয় লাভ করবার জন্য এবং নতুন আলো ও নতুন পথের জন্য তিনি অধীর হয়ে ওঠেন, দ্বারকা থেকে কয়েক মাইল দূরে অরণ্যময় এক পর্বতের গুহায় একদিন এক শক্তিধর যোগীর সাক্ষাৎ পান তিনি, হরভজন সেই যোগীর চরণে লুটিয়ে পড়ে কেঁদে বলেন, “আমায় কৃপা করুন,আপনার চরণ তলে রেখে যোগ দীক্ষা দিন।” যোগী বরের কৃপা হয়, কিন্তু তিনি বলেন,“ বেটা আমি সহজে কাউকে দীক্ষা দিই না। তাছাড়া তোমার গুরু অন্য জায়গায় রয়েছে, তবে আমি তোমাকে কিছু যোগ সাধন শিখিয়ে দেবো, যাতে তোমার কল্যাণ হবে।” এরপর সেই মহাযোগীর চরণতলে বসে হরভজন নিগূঢ় যোগ সাধনার শুরু করেন এবং তারপর আরো বেশ কয়েকটি বিখ্যাত বিখ্যাত তীর্থ ভ্রমণ করে ফিরে আসেন নিজের দেশে। এরপর গাজীপুর ও কুর্থা অঞ্চলে সাধু-লছমীনারায়ণের আশ্রমের ভার নেন হরভজন। ছোটো থেকেই তিনি রামানুজপন্থী বৈষ্ণব সাধনা অনুসরণ করে এসেছিলেন এবার তার সাথে যুক্ত হল যোগশক্তি।
কুর্থার আশ্রমে একটি মাটির গুহা নির্মাণ করে হরভজন কঠিন ভজন সাধন শুরু করেন, ঠিক এই সময়ে তিনি শুধু দু-চারটে বেলপাতা বেটে খেতেন বা কখনো কখনো এক পোয়া দুধ খেতেন, সেই কারণে তার নাম হয়ে যায় পওহারী বাবা। সাধন লোকের দিব্য অনুভূতি ও আনন্দ লাভ করার পরেও তার মন পরিতৃপ্ত হয় নি। গুরুর সন্ধানে আশ্রম ছেড়ে বের হন তিনি, অযোধ্যায় গিয়ে তিনি শুনতে পান রামানুজ সম্প্রদায়ের কোনও উচ্চকোটি সাধক নদী তীরের একটি আশ্রমে নিভৃতে তপস্যা করছেন। তখন তিনি মনের মধ্যে আশার আলো দেখতে পান, তার মনে হয় এই তাঁর বহু আকাঙ্খিত দীক্ষা গুরু আর কাল বিলম্ব না করে একদিন সকালে সেই সাধুর ভজন গুম্ফায় গিয়ে তিনি উপস্থিত হন এবং সকাতরে গুরুর আশ্রয় প্রার্থনা করেন। ঐ বৈষ্ণব তপস্বীর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করে আবার পওহারি বাবা ফিরে আসেন তার কুর্থা গাজীপুরের আশ্রমে।
তার দীর্ঘ জীবনে তিনি ভক্তদের প্রচুর কল্যাণ করেছেন,অনেক অলৌকিক সাধন করেছেন। একবার বাবা কঠিন দেহ চর্মের রোগে আক্রান্ত হন,তার শরীরে প্রবল জ্বর দেখা দেয় আর তার সাথে হয় স্বরভঙ্গ। সেই সময় তার আরোগ্য কামনায় শাস্ত্রবিদ ব্রাহ্মণগণ তার জন্য ওষুধ এনে দেন কিন্তু রাত্রে সেই সমস্ত ওষুধ গঙ্গায় ফেলে দেন বাবা। পরদিন ভক্তরা ওষুধ ফেলে দেওয়ার কথা জানতে পেরে অনুযোগ করতে থাকেন,“ওষুধ পত্র খাবেন না বললেই হতো, এভাবে তিনি পয়সা নষ্ট করলেন কেন?” তখন বাবা বলেন,“ সবই আমি গ্রহণ করেছি, দেখ তো, জ্বর সেরে গেছে, স্বরভঙ্গ নেই গায়ের ফোস্কাও মিলিয়ে গেছে।” সবাই তখন তাকিয়ে দেখে ওষুধ ছাড়াই বাবা আরোগ্য লাভ করেছে।
একবার অযোধ্যা থেকে একজন ভন্ড সাধু বাবার গাজীপুরের আশ্রমে এসে আশ্রয় নেয়। সেই সাধু যেমন কপট তেমনি দাম্ভিক, কিছুদিন পর দেশ পর্যটনের অজুহাত দেখিয়ে পওহারী বাবার থেকে প্রচুর টাকা দাবি করে লোকটি কিন্তু বাবা সেই অর্থ দিতে না চাইলে ভন্ড সাধু বাবাজিকে সেই আশ্রম ছেড়ে যেতে বলে, আদেশ শিরোধার্য করে বাবা তখন আশ্রম ত্যাগ করে শ্রীক্ষেত্রের দিকে যাত্রা করেন। পওহারী বাবা স্থির করেন যে, প্রভু জগন্নাথের দর্শন করে এবং তীর্থে তীর্থে ঘুরে জীবনটা তিনি কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু সেই সময় কিছু গুরুতর পীড়ায় বাবা আক্রান্ত হন, তখন মুশিদাবাদ জেলার ব্রহ্মপুর গ্রামে এসে বেশ কিছুদিন তাকে থাকতে হয়। ভক্তরা বহু অনুসন্ধান করে তাকে আবার গাজীপুরে ফিরিয়ে আনেন। স্বামী বিবেকানন্দ পওহারী বাবার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের মৃত্যুর পর তিনি এসেছিলেন বাবার কাছে, তার চরণ তলে বসে অমৃতময় জীবন লাভ করা যায় কিনা তা পরীক্ষা করবার জন্য, পরে তিনি বুঝতে পারেন, বাবা সত্যি একজন মহাপুরুষ। নিজের লেখা চিঠিতেও তিনি বাবার অলৌকিক ক্ষমতার উল্লেখ করেছিলেন ও বাবার সান্নিধ্য লাভ করে শান্তি লাভের কথা বলেছেন।
একবার সাপের আক্রমণের থেকে ছোটা একটি ইঁদুরকে বাবা তার কোলে আশ্রয় দেন, তখন সেই বিষধর সাপটি বাবাকেই দংশন করে এবং বাবা অচেতন হয়ে পড়েন। আশ্রমে মহাশোরগোল হয়ে যায়। ওঝা,যাগযজ্ঞ কোনো কিছুতেই যখন ফল হয় না তখন ঘটে এক অলৌকিক দৃশ্য, নিজেই নিজেকে সুস্থ করে উঠে বসেন বাবা। সবাই আরো একবার বুঝতে পারেন বাবা সিদ্ধ যোগী। ১৮৯৮ সালে পওহারী বাবা একদিন নিজের প্রজ্জ্বলিত হোমকুণ্ডে আত্ম বিসর্জন করে ইহজাগতিক লীলা সাঙ্গ করেন।