কথাই বলে 'যে খায় চিনি তাকে যোগায় চিন্তামনি'। বাস্তবিকভাবে আমরা যদি ভেবে দেখি তাহলে আমাদের খাওয়ার যাবতীয় দায়িত্ব কিন্তু বহন করেন অখিল ব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বর ভগবান শ্রী নারায়ণ। তিনি জগৎ পালক পিতা, তাই তার সংসারে কে অভুক্ত থাকবেন আর কে খাবার খাবেন, সেই সবটাই তার অঙ্গুলি হেলনে হয়, মানুষ যে তারই দাস, পৃথিবীর একটি পাতাও যে তার ইচ্ছে ছাড়া নড়ে না তা বারংবার প্রমাণ হয় যখন আমরা ভক্তমালে বিভিন্ন সাধক ভক্তদের জীবনী পড়ি। এরকমই বৈষ্ণবশ্রেষ্ট সাধক মাধবেন্দ্রপুরীর জীবনী পড়লে বোঝা যায় উপরিউক্ত প্রবাদবাক্যের যথার্থতা। শ্রীধাম বৃন্দাবনের গোবর্ধন পর্বত পরিক্রমা শেষ করে মাধবেন্দ্রপুরী গোবিন্দকুণ্ডের তীরে বসে ছিলেন অভুক্ত অবস্থায়। স্নান ও মধ্যাহ্ন জপ শেষ করে ফেলেছেন তিনি, এরপর তার আরাধ্যদেবকে ভোগ নিবেদন করে তিনি কিছু প্রসাদ গ্রহণ করবেন- এমনটাই তার মনোবাঞ্ছা! কিন্তু ভিক্ষা জুটবে কী?
গত তিন দিন ধরে জনমানব শূন্য এলাকায় কোনও ভিক্ষা পাননি তিনি। ইষ্টদেব অভুক্ত রয়েছেন তার, সেই কারণে তিনিও তিনদিন ধরে কিছু খাননি। আজ ভিক্ষা জুটবে বলে কোনও আশা ছিল না তার, সেই কারণে ভিক্ষা পাওয়ার আশায় এবং আহারের আশা ছেড়ে দিয়ে গাছের ছায়ায় শুয়ে ছিলেন ভক্তশ্রেষ্ঠ মাধবেন্দ্রপুরী। ভক্ত শ্রেষ্ঠ এই কারণেই বললাম কারণ যাকে ক্ষুধার্ত দেখে স্বয়ং অখিল ব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বর নারায়ণ ছুটে আসেন খাবার নিয়ে তিনি ভক্ত শ্রেষ্ঠ না হলে আর কে ভক্ত শ্রেষ্ঠ হবে? তিন দিন উপবাসী মাধবেন্দ্রপুরীর ক্ষেত্রেও এমনটাই হল। মাধবেন্দ্রপুরী যখন গাছের ছায়ায় শুয়ে ছিলেন, তখন প্রিয় দর্শন বালক দুধের সরা হাতে উপস্থিত হল। এসে সে বলল এই দুধটুকু খেয়ে নাও।
মাধবেন্দ্রপুরী সেই দুধ ইষ্টদেবকে নিবেদন করে নিজে পান করলেন। এরপর রাত্রি হল, পুজো ও কীর্তন জপ শেষ করে তিনি সেখানেই ঘুমিয়ে পড়লেন। রাত্রি শেষে হঠাৎ যখন তার ঘুম ভেঙ্গে গেল তখন দেখলেন চারদিক আলোকিত করে বনের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে সকালের সেই বালক। মাধবেন্দ্রপুরীকে সে বলছে, এই গ্রামের শেষ প্রান্তে মাটির নিচে আমার শিলা বিগ্রহ রয়েছে বিধর্মীর আক্রমণের সময় ভক্তরা ঐখানে লুকিয়ে রেখেছিল তুমি তা উদ্ধার কর।
মাধবেন্দ্রপুরী বুঝতে পারলেন ওই বালক আসলে কে। এরপর বালক মূর্তি অদৃশ্য হয়ে গেলে মাধবেন্দ্রপুর গ্রামের লোকজনকে দেখে অলৌকিক স্বপ্নের কথা প্রচার করলেন। এরপর বৃন্দাবনের পল্লীতে ছুটে চললেন মাধবেন্দ্রপুরী তার সঙ্গে কোদাল ও শাবল হাতে ছুটল গ্রামবাসীরা অনেক ধান খোঁজার পর শেষে মাটি খুঁড়ে, গোপাল মূর্তি। মহা ধুমধামের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হলেন গোপাল। একজন বাঙালি পুরোহিত নিয়ে এসে সেই গোপাল মূর্তি পুজো করার ব্যবস্থা করলেন মাধবেন্দ্রপুরী।
গোপালের সেবায় মাধবেন্দ্রপুরী বৃন্দাবনের ব্রজভূমিতে প্রায় দুই বছর কাটিয়ে দেন। এরপর গোপাল একদিন স্বপ্নে মাধবেন্দ্রপুরীকে দেখা দিয়ে বললেন , "পুরী গোঁসাই! বহুকাল মাটির নীচে থাকায় আমার সারা দেহে দেখা দিয়েছে প্রবল জ্বালা। মলয়জ চন্দন না হলে দেহের এ জ্বালা জুড়াবে না। সে চন্দন পাবে তুমি নীলাচলে। দারুণ গ্রীষ্মে ভক্তরা জগন্নাথ দেবকে সেই চন্দন মাখায়। তাই আমার চাই।"
বৃন্দাবন ধাম থেকে পরের দিনই মাধবেন্দ্র পদব্রজে উড়িষ্যার দিকে রওনা হলেন, দিকে দিকে সেই সংবাদ রটে গেল। জগন্নাথের পান্ডা থেকে রাজ কর্মচারী সকলেই এসে মাধবেন্দ্রকে প্রচুর চন্দন কাঠ ও কয়েক ভাঁড় সুগন্ধি কর্পূর দিলেন। এরপর মাধবেন্দ্র বৃন্দাবনের পথে রওনা হলেন, কিছুদিন চলার পথ তিনি রেমুনায় শ্রী গোপীনাথের মন্দিরে পৌঁছলেন, সেখানে তিনি নাম কীর্তন ও সেবা পুজোয় ব্যস্ত ছিলেন। ঠিক সেই সময়ে মাধবেন্দ্রপুরী এক অপূর্ব স্বপ্ন দেখলেন। ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিমায় গোপাল জ্যোতির্ময় মূর্তিতে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন গোপাল মাধবেন্দ্র পুরীকে বললেন, " বৎস তোমাকে আর দৌড়ঝাঁপ করে বেড়াতে হবে না। তোমার আনা চন্দন কর্পূর আমার কাছে পৌঁছে গেছে।" অবাক হয়ে গেলেন মাধবেন্দ্রপুরী। বৃন্দাবন তো এখান থেকে অনেক দূরে, কিন্তু প্রভু এ কী বলছেন?
গোপাল তখন বললেন," গোপীনাথের অঙ্গ আমার অঙ্গ একই। তুমি গোপিনাথের দেহে কর্পূর চন্দন রোজ লেপন করো তবেই আমার দেহ শীতল হবে।" মাধবেন্দ্রপুরী তাই করলেন। এরপর গ্রীষ্মকাল শেষ হলে তিনি চলে গেলেন নীলাচলে, সেখানে বেশ কিছুকাল কঠোর তপস্যা করেন।
মাধবেন্দ্রপুরীর শিষ্যই ছিলেন ঈশ্বরপুরী যিনি গয়া ধামে শ্রী চৈতন্যকে গোপাল মন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিলেন। মাধবেন্দ্রপুরীর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাকে অক্লান্তভাবে সেবা করে গিয়েছিলেন ঈশ্বর পুরী। কথিত আছে একটি সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মাধবেন্দ্রপুরীর স্ত্রী বিয়োগ ঘটলে তার মধ্যে বৈরাগ্যের জন্ম হয় ও তিনি শিশু পুত্রকে নিয়ে শ্রীহট্ট জেলা থেকে বিষ্ণুপুর গ্রামে চলে আসেন ও সেখানে চতুষ্পাঠী খুলে বসেন। মাধবেন্দ্রপুরীর চতুষ্পাঠীতে কমলাক্ষ নামের একটি ছাত্র পড়তে এসেছিল, যিনি গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের তিন প্রভুর এক প্রভু অদ্বৈত রূপে আত্মপ্রকাশ করেন পরবর্তীকালে। মহাপ্রভু চৈতন্য দেবের আবির্ভাবের কিছু পূর্বেই বা পরেই মাধবেন্দ্রপুরী ইহলৌকিক লীলা ত্যাগ করে বৈকুন্ঠবাসী হন। অনুমান করা হয় ১৪০০ খ্রীস্টাব্দ থেকে ১৪৮০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ইনি জীবিত ছিলেন।