মুর্শিদাবাদের ডাহাপাড়ায় পন্ডিত দীননাথ ন্যায়রত্নের সদ্যজাত পুত্রের ঠিকুজি দেখে নেপালী সন্ন্যাসী চমকে উঠে জিজ্ঞেস করেন,“এই শিশুটি কোথায়? আমায় একবার দেখাতে পারেন?” ন্যায়রত্ন তখনই ছুটে গিয়ে শিশুপুত্রকে সাথে করে নিয়ে এলেন। সন্ন্যাসী তাকে কোলে নিয়ে তারপর তার পা দুখানি বারবার মাথায় ঠেকাতে লাগলেন আর বললেন,“ এ শিশু সর্বসুলক্ষন যুক্ত। এ একদিন বিরাট মহাপুরুষ হবে। এর দর্শন পেয়ে আমি ধন্য হলাম।” এই বলে নেপালী সেই সন্ন্যাসী অন্তর্হিত হলেন। ছেলেটির নাম রাখলেন তার বাবা-মা ‘জগৎ’। এই জগৎই পরবর্তীকালে হয়েছিলেন প্রভু জগৎবন্ধু,যার নামে জগৎবন্ধু আশ্রম।
১৮২১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মে জগৎ জন্মগ্রহণ করেন মুর্শিদাবাদ জেলার ডাহাপাড়ায়। জগতের বাবার নাম দীননাথ ন্যায়রত্ন আর মায়ের নাম বামা দেবী। জগতের পরিবারের আদিবাস ফরিদপুরে। সেখান থেকে এই পরিবার মুর্শিদাবাদে এসে ওঠেন। ন্যায়রত্ন মশাই নিজের পৈতৃক ভিটা ছেড়ে যখন মুর্শিদাবাদে আসেন তখন তিনি অধ্যাপনা শুরু করেন।
অল্প বয়সেই জগতের বাবা ও মা মারা গিয়েছিল।এরপর জগৎ মানুষ হতে থাকেন তার একজন আত্মীয়া দিদির কাছে পাবনায়। এক আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে জগৎ পড়াশোনা আরম্ভ করে। কিন্তু পড়াতে তার মন বসে না, কোথাও নাম কীর্তন ও মৃদঙ্গের ধ্বনি শুনলেই সে বিহ্বল হয়ে পড়ে। মোহাবিষ্ট অবস্থায় সাধক সুলভ নানারকম ভাব তার দেহে প্রকাশিত হতে থাকে। শহরের উপকণ্ঠে পুরোনো বটগাছের তলায় আছে একটি ভাঙাচোরা অন্ধকার ঘর, জগৎ প্রায়ই সেখানে যায়। সেই ঘরে একজন অর্ধ উলঙ্গ উন্মাদ থাকে, শহরের ছোট থেকে বড় সবাই তাকে ‘ক্ষ্যাপা’ বলে। অথচ জগতের কাছে সে বড় আপন জন! জগত যে তার থেকে কি শেখে কে জানে?- এই ক্ষ্যাপা একদিন জগতের দিদিকে বলেই ফেলেন,“দেখ দিদি জগা মানুষ নয়। আমিও মানুষ নয়। তবে জগা হলো রাজা আর আমরা সবাই প্রজা।”
এই জগত ধীরে ধীরে মানুষের কাছে প্রভু জগৎবন্ধু রূপে পরিচিত হলেন। ধীরে ধীরে তার মধ্যে বৈষ্ণব মহাপুরুষের লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকলো আর দূর-দূরান্ত থেকে তাকে দেখবার জন্য প্রচুর মানুষ ছুটে আসতে শুরু করলেন। জগৎবন্ধু এবার ঠিক করলেন তিনি তীর্থ পরিক্রমায় যাবেন, তীর্থ পরিক্রমা করতে গিয়ে তিনি গেলেন বৃন্দাবনে! বৃন্দাবন যেখানে রাধারানীর চরণধূলি লেগে আছে! সেখানে গিয়ে জগৎ গড়াগড়ি দিতে শুরু করলেন- এই বৃন্দাবনে এসেই তার মধ্যে এক অদ্ভুত ভাবান্তর ঘটলো। তার মনের মধ্যে দুর্নিবার এক আকাঙ্ক্ষা তৈরি হলো, রাধারানীর দর্শন লাভ করবার। রাধারানীকে দর্শন করতে না পারলে যে তার জীবন বৃথা এই কথাটি যেন অন্তরে অনুভব করতে শুরু করলেন জগৎবন্ধু আর প্রায় উন্মাদের মত হয়ে উঠলেন তিনি। কখনো তিনি আকুল কণ্ঠে ডাকেন কখনো আবার মাটিতে আছড়ে পড়ে কাঁদেন। রাধা কুন্ডের তীরে ধরে তিনি ছুটে যেতে শুরু করলেন।
তারপর একদিন এল সেই চির আকাঙ্খিত দিন। রাত্রের ঘন ঘোর অন্ধকারের মাঝে জগৎবন্ধু দেখলেন মহাভাবময়ী শ্রী রাধারানী কে। রাধারানীর দর্শন পাওয়ার পর তার স্তব শুরু করে দিলেন জগৎবন্ধু আর এরপরেই চেতনা হারিয়ে ভূমিতে পড়ে গেলেন তিনি।
প্রকৃতস্থ হওয়ার পরেই জগৎবন্ধুর মনে আর আনন্দের সীমা নেই। যদি কেউ তাকে জিজ্ঞাসা করতেন,‘প্রভু আপনার গুরু কে? প্রেম সাধনার দীক্ষা আপনাকে কে দিয়েছেন?” জগৎবন্ধু জবাব দিতেন,“ আমার গুরু বৃষভানু নন্দিনী রাধা, তিনিই আমাকে শক্তি দিয়েছেন।”
রাধারানীর থেকে প্রেমের শিক্ষা পেয়ে তিনি কৃষ্ণ নাম বিতরণ করেছেন জাতি ধর্ম নির্বিশেষে। জগৎবন্ধুর বাণী ছিলো,“নিরন্তর কৃষ্ণ নাম লিখবে, জসবে এবং চিন্তা করবে। কৃষ্ণই গতি, কৃষ্ণই পতি। এটাই সারকথা, পরম ধর্ম। মানসে সর্বদা যুগল সঙ্গ করে নিজেকে দাসী মনে করবে। কৃষ্ণকান্তি সদা নয়নে ও মানসে ভাসবে, কৃষ্ণই জীবনের ব্রত। তাকে ছাড়া অন্য কিছু জানবে না, ভাববে না।” এই ছিলো প্রভু জগৎবন্ধুর মূল বাণী। এই বাণী পরবর্তীকালে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজে গভীর প্রভাব ফেলেছিলো। বৃন্দাবনের রাধারানীর কৃপালাভ করবার পর জগতবন্ধু ফরিদপুরের ব্রাহ্মণকান্দায় নিজের গ্রামে এলেন, তরুণ সাধক গ্রামে আসায় তাকে কেন্দ্র করে কীর্তন আনন্দে মুখরিত হয়ে উঠলো সারা গ্রাম। এই সময় জগৎবন্ধু জানতে পারলেন, ফরিদপুরে শহরের প্রান্তে বুনো বাগদীদের বাস। জগৎবন্ধু খবর পেলেন সেই বুনোদের খ্রিস্টান করে নেবার জন্য প্রবল চেষ্টা হচ্ছে,অনেক ক্ষতি হবে। একেই হিন্দু সমাজ জরাজীর্ণ , তার ওপর বুনোরা খ্রিস্টান হলে হিন্দু সমাজের অনেক ক্ষতি হবে। জগৎবন্ধু বুনো বাগদীদের মোড়ল রজনী সর্দারকে ডেকে পাঠালেন। রজনী এলে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,“ রজনী মনে রেখো তোমরা বুনো জাতিরা হীন নও। তোমরা হলে শ্রী হরির দাস। কেন তোমরা ধর্ম ত্যাগ করবে? হরিনাম করো সকলে ধন্য হও।” ভাবান্তর ঘটলো রজনীর মনে, তারা খ্রিস্টধর্ম অবলম্বন করবার বাসনা ত্যাগ করে মোহান্ত সম্প্রদায়ে পরিণত হলো, কলকাতার রাম বাগানের ডোমদের ও জগৎবন্ধু এই একই ভাবে ধর্মান্তরিত হওয়ার থেকে রক্ষা করেছিলেন।
ব্রজগোপীভাবে ভাবিত ছিলেন প্রভু জগৎবন্ধু। কৃষ্ণ সাধনায় মধুরা রীতির সাধক ছিলেন জগৎবন্ধু। সর্বাঙ্গ তিনি কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতেন। জমিদার কালী কৃষ্ণ ঠাকুরের বাগানবাড়িতে তিনি কিছুদিন বাস করেছিলেন , সেইসময় জগৎবন্ধু প্রতিদিন কাপড়ে শরীর ঢেকে গঙ্গাস্নানে যেতেন। তাই দেখে কালীকৃষ্ণ ভেবেছিলেন কোন নারী বুঝি ছলনা করে তার বাগান বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে! পরে ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হন তিনি! জগৎবন্ধুর নির্দেশেই ভক্ত প্রেমানন্দ ভারতী বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারের জন্য আমেরিকায় যান এবং বহু মার্কিন ভক্তকে দীক্ষা দেন। তিনি সেখানে শ্রীকৃষ্ণ হোম নামে একটি সাধন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন।
১৩০৯ সন থেকে প্রভুর মৌনাবলম্বন ও নিভৃতবাস শুরু হয় আর ১৩২৮ বঙ্গাব্দের পয়লা আশ্বিন তিনি অগণিত ভক্তবৃন্দকে কাঁদিয়ে তাঁর ইহলৌকিক লীলা সমাপ্ত করেন।