কেউ কেউ আজন্ম সংসারের মধ্যে থেকে যান আর কেউ কেউ ভক্ত হয়ে বেরিয়ে যান সংসারের মোহ মায়া কাটিয়ে। কেউ আবার মাতৃ আজ্ঞা পালন করতে সংসারী হলেও সংসার তার টেকে না, আসলে ভক্তদের জীবন কাহিনী পড়লে বোঝা যায় আমাদের জীবনের সমস্ত সুতোই সেই আদি অনন্ত ভগবানের আঙুলে বাঁধা। তার ইচ্ছা ছাড়া আমাদের নড়বার জো টুকু নেই, আজ সেই রকমই এক সাধকের গল্প বলবো, মাতৃ আজ্ঞা পালনে যিনি বিয়ে করলেও তার জীবনের অবধারিত সন্ন্যাস তাকে ঘর ছেড়ে বাইরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। আজ বলবো সাধক দুর্গা চৈতন্য ভারতীজীর বিষয়ে।
একটি মাত্র সন্তান ছিল কাশীনাথ ঘোষের। সেও অকালে মারা গেল কাশীনাথ ঘোষ অভিজ্ঞ বৈদিক আনিয়ে সাত দিনব্যাপী একটি যজ্ঞ করালেন, পুর্নাহুতির দিন স্ত্রী মুক্তকেশী দেবী প্রসাদ গ্রহণ করে রাত্রে স্বপ্ন দেখলেন এক জটাজূট ভূষিত ত্রিশূলধারী সাক্ষাৎ শিবরূপী পুরুষ তাকে বলছেন,“তোমার এক দীর্ঘায়ু সৎপুত্র হবে তুমি এই মন্ত্রটি নিত্য জপ করো। এই বলে সেই পুরুষ মুক্তকেশী দেবীকে একটি বীজ মন্ত্র দান করে অন্তর্ধান হলেন।” এর কিছু কাল পরেই ১২৭৮ বঙ্গাব্দের ২২ শে আষাঢ় অর্থাৎ ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে ফরিদপুর জেলার উলপুর গ্রামে জন্ম হয় দুর্গানাথের।
তবে দুর্গানাথের ভাগ্যে পিতার স্নেহ বেশি দিন জোটে নি। কারণ তার যখন মাত্র চার বয়স বছর বয়স তখনই তার বাবার মৃত্যু হয়, এরপর মায়ের ভালোবাসায় বেড়ে ওঠে, দুর্গানাথ, দুর্গানাথের বয়স যখন মাত্র ১৫ বছর সেই সময় তার মনের মধ্যে সংসার বৈরাগ্যের ভাব সৃষ্টি হয়। ১২৯৮ সনে কলকাতা থেকে দুর্গানাথ মেট্রোপলিটন কলেজে পড়াশোনা করেন। সেই সময় পরিব্রাজক আচার্য স্বামী রামানন্দ ভারতীজী মহারাজ সুকিয়া স্ট্রিটের একটি বাড়িতে এসেছেন সেখানেই তার সাথে দেখা হয় দুর্গানাথের। সেই সন্ন্যাসীর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব দেখে আকৃষ্ট হন দুর্গানাথ।
রামানন্দ ভারতীজীর কথাবার্তা শুনে দুর্গানাথের মন শ্রদ্ধায় ভরে ওঠে তার স্নেহের বন্ধনে তিনি বাধা পড়ে যান এরপর ২৩ মার্চ শুক্রবার অষ্টমী তিথিতে শ্রী অদ্বৈত আচার্য প্রভুর আবির্ভাব দিবসে দুর্গানাথ স্বামী রামানন্দ ভারতীর নিকট দীক্ষা লাভ করেন, সেই সময় তিনি সন্ন্যাস চেয়ে ছিলেন কিন্তু স্বামীজি সে প্রস্তাবে রাজি হন নি, তিনি সন্ন্যাস দীক্ষা দেন নি শিষ্যকে। শিষ্যকে সন্ন্যাস দীক্ষা না দিলেও শিষ্যের মনের গতি স্বামীজী সেই দিন বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন। দীক্ষান্তে স্বামীজি শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর সন্ন্যাস বিষয়ক কীর্তনটি গেয়ে ছিলেন, ‘আমার ডোর কৌপীন দাও ভারতী গোঁসাই, সংসার বাসনা আমার মনে নাই”- এই গানটি গাইতে গাইতে কাশীধামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এই গান শুনে সেদিন নতুন দীক্ষা নেওয়া দুর্গানাথের মনও উদাস হয়ে গেল।
সংসারে যার মন নেই, সন্ন্যাস যাকে সবসময় টানে, সে কীভাবে ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে নিজেকে আটকে রাখবে? তাই সন্ন্যাস নেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে পাঠ্যপুস্তক পড়তে পড়তে একদিন সেটা খোলা রেখেই এক কাপড়েই কাশীধামের দিকে পাড়ি দিলেন দুর্গা নাথ। তিনি গিয়ে পৌছলেন স্বামীজীর পদপ্রান্তে। স্বামীজি বুঝতে পারলেন দুর্গানাথ বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছেন, তখন তার আত্মীয়দের তিনি তৎক্ষণাৎ খবর দিলেন, দুর্গা নাথের এক ভাই এসে তাকে পাঠিয়ে দিলেন ময়মনসিংহে তার মায়ের কাছে,বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনায় সেখানেই ইতি ঘটলো তার।
স্বামীজীর উপদেশ মতো দুর্গানাথ দিনচর্যা, গীতাদি পাঠ, জপাদি কাজ যথা নিয়মে করতে লাগলেন। দুর্গানাথের এইসব কাজ কর্ম দেখে মা ও আত্মীয়-স্বজনরা অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে উঠলেন, উদাসী দুর্গা নাথের কিন্তু কোন দিকে খেয়াল নেই, কে কী ভাবছে, কে কী বলছে তাই নিয়ে ভাবার সময় কোথায় দুর্গানাথের? সে তো এক ইষ্ট চিন্তায় মগ্ন হয়ে রয়েছে দিনরাত! যথাসময়ে নিজের গীতা পাঠ জপের কাজ সমস্ত কিছু সময় সময় চলছে তার, আর প্রতিদিন সন্ধ্যায় ব্রহ্মপুত্র নদের নির্জন তটে বসে এক মনে গভীর ধ্যানে ডুবে থাকছেন তিনি। একদিন রাতের অন্ধকারে ব্রহ্মপুত্র তট থেকে ফেরবার সময় একটি উজ্জ্বল অথচ স্নিগ্ধ আলোক তিনি দেখতে পেলেন, যা তার গোটা শরীরকে মুহূর্তেই ঢেকে ফেলল। সেই দিন এক আশ্চর্য অনুভূতি হল তার! একজন পন্ডিত সন্ন্যাসী দুর্গানাথকে উপনিষাদাদি আধ্যাত্ম শাস্ত্র কিছু পড়িয়ে ছিলেন। দুর্গানাথও সেই সব শাস্ত্রের মধ্যে তার নিজের হৃদয়ের প্রতিধ্বনি শুনতে পেয়ে তৃপ্ত হয়েছিলেন, ফিরে যাওয়ার সময় সন্ন্যাসী বললেন,“ তুমি পঞ্চদশী ইত্যাদি পড়ো”
দুর্গানাথ স্বপ্নে অনেক তথ্য জানতে পারতেন এক সময় দুর্গানাথের মনে তাদের কুল দেবতা কে তা জানবার জন্য আকাঙ্ক্ষা প্রবল হয়ে উঠল, সে কথা অন্য কাউকে তিনি জিজ্ঞেস করেন নি, কিন্তু স্বপ্নে তথ্য লাভ হয়ে গেল। তিনি দেখেন যে, তাঁর গুরু একটি ঝাঁপি খুলে একটি জ্যোতির্ময়ী শক্তি দেখাচ্ছেন, পরে তিনি জানতে পারলেন যে ঐটি তাদের কুল দেবতা। রামানন্দ স্বামী কিন্তু দুর্গানাথ তাকে বলবার আগে এ সম্বন্ধে কিছুই জানতেন না। দুর্গানাথ এই ঘটনার পরে বলেন, “ এতে প্রমাণিত হয় যে, চিত শক্তি জীবের অন্তরস্থ ব্রহ্ম শক্তিই গুরুরূপে প্রকৃটিত হন।”
দুর্গা নাথ ১৮৯৪ সালে মন্দিরে যান সেখানে তিনি এক সাহেবের চেষ্টায় একটি চাকরি পান সেই চাকরিতে যথেষ্ট উপরি ছিল। অন্য সকলেই তা অবাধে নিতেন কিন্তু দুর্গানাথ এই উপরিকে অন্তরের সঙ্গে ঘৃণা করতেন। ১৯০৫ সালে দুর্গা নাথের মায়ের ইচ্ছা হয় সেবার তিনি ভরা কার্তিক মাসটা কাশীধামে বাস করবেন, দুর্গনাথ ছিলেন অত্যন্ত মাতৃবৎসল পুত্র। মায়ের ইচ্ছা পূরণ করতে তিনি সেই মুহূর্তে মাকে নিয়ে ছুটলেন কাশীধামে। মাকে নিরাপদে সেখানে রেখে চলে এলেন মুঙ্গেরে।
দুর্গা নাথ তার দীর্ঘ জীবনে কখনও মায়ের কথা অমান্য করেননি, তাই মায়ের নির্দেশেই দুর্গানাথ বিবাহ করলেন। বিবাহের সময় স্পষ্ট অনুভব করলেন যে, শ্রীগুরু তার মস্তকে প্রত্যক্ষ বিরাজ করছেন। কিন্তু সন্ন্যাস যার পথ সংসার সুখ তার সইবে কেন! বেশিদিন স্ত্রীকে নিয়ে সংসার করতে হয়নি দুর্গানাথকে, ১৯১০ সালের মার্চ মাসে স্ত্রী হঠাৎ মারা গেলেন।
এরপর দুর্গানাথ শুরু করলেন তীর্থ পরিক্রমা। তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়াতেন তিনি আর সেই সঙ্গে শুরু হলো তার যোগ সাধনার পালা। এইসময় থেকেই তার যোগ বিভূতির মহিমা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল আর দুর্গানাথ শ্রীমৎ স্বামী দুর্গা চৈতন্য ভারতীজী নামে খ্যাতি লাভ করেন, হয়ে ওঠেন এক মহা সাধক। তার মৃত্যুর সাল তারিখ সেভাবে জানা যায় না, তবে তার তিরোধানের পর এক মহাসাধকের অভাব অনুভূত হয়।