এক গৃহীর সংসার ত্যাগ করে বৈষ্ণব সাধু হ‌ওয়ার কাহিনী

জমিদারবাড়ির ডাকসাইটে দৌদণ্ড প্রতাপ কর্মচারী রা‌ইচরণ ঘোষ, ঘর সংসারী আদ্যপ্রান্ত গৃহী রাইচরণ ঘোষ ভগবত কৃপায় হয়ে ওঠেন বৈষ্ণব সাধু ও নাম মাহাত্ম্যের শ্রেষ্ঠ প্রচারক চরণ দাস বাবাজী। তার জীবন কাহিনি পড়লে আমরা বুঝতে পারি ভগবত কৃপায় কিনা হয়! আজকে তাই পরম বৈষ্ণব চরণ দাস বাবাজীর জীবনের কথা বলব।

১২৬০ বঙ্গাব্দের ১৯ চৈত্র যশোহর জেলায় জন্মেছিলেন রাইচরণ ঘোষ। রাইচরণের যখন ৫ বছর বয়স, মৃত্যু হয় তার বাবা মোহনচন্দ্র ঘোষের। রাইচরণের মা কনক সুন্দরীর দুটি সন্তান মৃত্যুর পর জন্ম হয় রাইচরণের, সেই কারণে অনেক স্নেহ আর আহ্লাদ দিয়ে ছেলেকে বড় করেন তিনি তারপর যৌবনে তিনি রাই চরণের বিয়ে দেন, কিন্তু তার দুটি পুত্রের পর সংসারে শোকের ছায়া নেমে এলে, বংশরক্ষার জন্য রাই চরণকে আর‌ও দুটি বিয়ে করতে হয়। রাইচরণ ছিল যশোহরের জমিদার গোঁসাই বাবুর ডাকসাইটে কর্মচারী, যেমন জবরদস্ত ছিল তাঁর চেহারা, তেমনি ছিল তেজ, খুব ভালো বন্দুক চালাতে পারতেন। একবার প্রজারা বিদ্রোহী হয়ে উঠলে রাইচরণ জমিদারের হয়ে প্রজাদের কাছ থেকে ধান কেড়ে নিয়েছিলেন, সেই ঘটনা তাঁকে বিবাগী করে দিল, তার মনের মধ্যে তৈরি করল সন্ন্যাসের ভাবনা।

সেবার প্রজারা কিছুতেই তাদের ক্ষেতের ধান জমিদারকে দেবে না বলে ঠিক করে। জমিদারের নির্দেশে রাইচরণ বরকন্দাজদের সঙ্গে নিয়ে বন্দুক হাতে এগিয়ে চললেন- তা দেখে প্রজারা ভয়ে পালিয়ে গেল, এরপর জমি থেকে ধান কেটে এনে স্তুপ করা হল কাছারি বাড়ির উঠোনে কিন্তু সেদিকে তাকিয়ে রাইচরণ বাবুর মনটা উদাস হয়ে গেল। তিনি মনে মনে ভাবলেন," এ আমি কি করলাম! দরিদ্র প্রজাদের মুখের খাবার কেড়ে আনলাম।"

সেদিন দুপুরের খাবার প্রস্তুত, স্নান করে তিনি খেতে বসবেন কিন্তু তাঁর আর খাওয়া হল না! সেই দিনই তিনি সংসার ত্যাগ করলেন, এরপর উত্তরবঙ্গের বিখ্যাত শক্তিপীঠ ভবানীপুরে গিয়ে পঞ্চমুন্ডীর আসনে রাইচরণ সাধনায় বসলেন, অল্পদিনের সাধনাতেই ইষ্ট দেবীর কৃপা লাভ হল। স্বয়ং মহামায়া, তার সামনে আবির্ভূত হয়ে বললেন," বৎস তুমি সরযূ তীরে যাও, সেখানেই তোমার আধ্যাত্ম্য জীবনের গুরু তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন।" এরপর রাই চরণ ভক্তি ভরে ইষ্ট মন্ত্র জপ করতে শুরু করলেন, অযোধ্যায় সরযূ নদীর তীরে  গিয়ে উপস্থিত হলেন তিনি। সেখানে গিয়ে খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ দেখলেন প্রিয়দর্শন এক বৈষ্ণব সন্ন্যাসী রয়েছেন, সেই সন্ন্যাসী রাইচরণকে দেখেই বললেন, "এসো বাবা, তোমার জন্যই যে আমি অপেক্ষা করে আছি" রাইচরণ তখন বুঝলেন এই মহামায়া নির্দেশিত সেই মহাপুরুষ।

দীক্ষা গ্রহণের কিছুদিন পর গুরুদেব তাঁকে বললেন, বাবা চরণদাস এবার তুমি নাম প্রচারে বেরিয়ে পড়ো। আমি আশীর্বাদ করছি বৈষ্ণব গ্রন্থ সমূহ তোমার অধিগত হবে। স্বয়ং মহাপ্রভু তোমার অন্তরে উদিত হয়ে তোমাকে সাহায্য করবেন। ‌

চরণদাস উত্তর ভারতের বহু তীর্থ দর্শন করবার পর শ্রীধাম নবদ্বীপে এসে পৌঁছান, শ্রীচৈতন্যদেবের স্মৃতি মাখা পবিত্র স্থানগুলি দর্শন করে তার অন্তরে অপূর্ব আনন্দের সঞ্চার হয়। ভক্তদের নিয়ে চারণ দল গঠন করে ভাবে মাতোয়ারা হয়ে গৌরাঙ্গ কীর্তন করে চলেন চরণদাস।

একবার  সঙ্গীদের নিয়ে শ্রীপাঠ কালনায় এলেন চরণদাস, সেখানে নামকীর্তনের তালে তালে একটি পাঁচ বছরের শিশু মূর্ছিত হয়ে বলল,"ওগো তোমরা আর এখানে দেরি করো না, এখনই নীলাচলের পথে যাত্রা করো।" এই অলৌকিক ঘটনা দেখে চরণদাস বুঝলেন, এটি নিশ্চয়ই ঈশ্বরের নির্দেশ, সেই দিনই তিনি কয়েকজন ভক্তকে নিয়ে পুরীধামের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। দীর্ঘ সময় পদব্রজে যাত্রা করে তারা সাক্ষী গোপালে গিয়ে পৌঁছোলেন ও রাত্রিতে আশ্রয় নিলেন সেই মন্দির চত্বরের কোণে।

ঘমন্ত অবস্থায় চরণদাস এক সুন্দর স্বপ্ন দেখলেন, তিনি দেখলেন, তার মাথার কাছে দু'জন দেব তুল্য পুরুষ দাঁড়িয়ে আছেন। একজনের গায়ের রং কাঁচা সোনার মতো আর একজনের গায়ের রং তুষারের মতো শুভ্র।  দ্বিতীয় পুরুষটি তাকে বললেন," বাবা তোমাকে এক নিগূঢ় মন্ত্র দিচ্ছি, নিষ্ঠা সহকারে তুমি এটি জপ করবে, এই মন্ত্র বিতরণ করবার অধিকারও তোমার রইলো।" বারোটি অক্ষরযুক্ত এক নিগূঢ় মন্ত্র দান করে পুরুষ দুটি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। চরণদাস জেগে উঠে আনন্দে চিৎকার করতে লাগলেন এই বলে," ওরে তোরা সব ওঠ, প্রভু নিতাই চাঁদ এখানে এসে আমাকে কৃপা করে গেলেন।"

নীলাচলধামে যাওয়ার পর চরণ দাসের ভক্ত সংখ্যা আরো বাড়তে থাকল আর  পুরীর রথযাত্রা কে উপলক্ষ করে বাবাজির সুনিবিড় কৃষ্ণভক্তি অলৌকিক ভাবে উদ্ভাসিত হতে থাকল। তার কীর্তনের প্রভাবে সবাই মুগ্ধ হয়ে গেলেন, এমনকি মুসলমান গ্রামবাসীরা পর্যন্ত ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করতে শুরু করল। কলকাতায় গিরিশ ঘোষের আমন্ত্রণে তিনি একবার স্টার থিয়েটারে চৈতন্য লীলা অভিনয় দেখতে যান, সেখানে একটি দৃশ্য দেখে প্রেক্ষাগৃহে তিনি অচৈতন্য হয়ে পড়েন। জ্ঞান ফিরে এলে গিরিশ ঘোষ চরণদাস বাবাজিকে বলেন," নাটকটি লিখে আমার গর্ব ছিল, আপনার কৃপা সঙ্গ পেয়ে আজ দেখছি, আমি এর কিছুই বুঝতে পারিনি।" সজ্ঞানে এই মহাপুরুষ তার ভবলীলা সাঙ্গ করেছিলেন,তবে ঠিক কত সাল নাগাদ তার তিরোধান হয় সেটা জানা যায়নি।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...