বিচারের বাণী যেথায় নিভৃতে কেঁদেছিল

তখন ইউরোপের নবজাগরণ শুরু হয়েছে। কবি দান্তে আলিঘিয়েরির জন্ম হয়েছিল সেই নবজাগরণের সময়। গদ্য রচয়িতা হিসেবে বিখ্যাত হলেও দান্তে ছিলেন একাধারে ভাষাতাত্ত্বিক, দার্শনিক, এবং রাজনৈতিক চিন্তাবিদ। তাঁর জীবন ছিল পাথুরে। ধাক্কা খেয়েছেন বারবার। তবুও আপোষ করেননি।

১২৬৫ সালে জন্ম দান্তে আলিঘিয়েরির।‌ অভিজাত পরিবারের সন্তান ছিলেন তিনি। শিল্প, সংগীতে অনুরাগ ছিল তাঁর। যৌবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। যেটা সঠিক, সমাজের পক্ষে মঙ্গলের মনে হতো সব সময় সেই পথেই হাঁটতেন দান্তে। ফলে সেই সময় ইউরোপের পোপের রোষানালে পড়েছিলেন।

ইউরোপ বিশেষ করে ফ্লরেন্সের রাজনীতি তখন দুই দলে বিভক্ত। দুটোই দল ছিল মূলত। গেলফ এবং ঘিবেলিন। 'কালো' এবং 'সাদা' নামেও এই দুই দলকে ডাকা হত। দান্তে ‘সাদা’ দলের সমর্থক ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন সমস্ত দেশ এমনকি সমস্ত পৃথিবী এক শাসনের অধীনে থাকা উচিত। আর সেই শাসন অবশ্যই সাদা, পবিত্র, শান্ত  এই গুণগুলির নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। পোপের অস্তিত্ব দান্তে অস্বীকার করতেন না । তবে সেটা ধর্মীয় ক্ষেত্রে মেনে নিতেন, কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পোপের হস্তক্ষেপ মেনে নেওয়ার ব্যাপারে অনীহা ছিল দান্তের।

FotoJet - 2022-07-16T155247.566

গেলফ অর্থাৎ কালো দল ছিল পোপের অন্ধ অনুরাগী। বিপদে পড়লেই তারা পোপের কাছে সাহায্য চাইত। অন্যান্য দেশের রাজাদের থেকে সৈন্য আনিয়ে এই কালো দলকে সাহায্য করত পোপ। এই দুই দলের সামরিক অভ্যুত্থান-পতনের ওপরেই নির্ভর করত এই কবির অবস্থান।

দান্তে একবার ফ্লরেন্সের বিচারক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন, এমন কি দু'মাসের জন্য তিনি ফ্লরেন্সের ছ’জন প্রধান পুরুষের মধ্যে অন্যতম একজন হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন।

মাত্র ২৪ বছর বয়সে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন দান্তে। সৈনিক হিসেবে লড়াই করেছিলেন। সেখান থেকে ফিরে আসার কিছুদিন পর তিনি শুনেছিলেন তাঁর ভালোবাসার মানুষ বিয়াত্রিসের মৃত্যুসংবাদ।

এই সময়কাল কঠিন ছিল তাঁর জন্য। অবসন্ন হয়ে পড়েছিলেন তিনি। শোকের কুয়াশা তাঁর অন্তরকে ঢেকে দিয়েছিল। তবে দুঃখ, যন্ত্রণা কখনো খুলে দেয় সৃষ্টির আগল। দান্তে এই সময় রচনা করেছিলেন তাঁর গীতি কবিতা - ভিটা নোভা (Vita Nuova)।

তবে প্রিয়তমার মৃত্যুতে দান্তে ছেড়ে দেননি তাঁর কর্ম-পথ। নিজের কর্তব্য ভোলেননি তিনি। একদিকে তাঁর সৃষ্টি চলছিল, অন্যদিকে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন রাজনীতিতে।

১৩০১ সালের অক্টোবর মাসে শ্বেত দলের পক্ষ থেকে তিনজন দ্যুতকে পোপের কাছে পাঠানো হয়েছিল। ফ্লরেন্সের সম্পূর্ণ অবস্থা বুঝিয়ে বলাই ছিল লক্ষ্য। কিন্তু ফল হল উল্টো। ফ্লরেন্স আক্রমন করা হল। ঘিবেলিনরা সম্পূর্ণভাবে ক্ষমতাচ্যুত হল।

শুরু হল অন্ধকারের রাজত্ব। বিচারের প্রহসন শুরু হল তারপর। বিরুদ্ধপক্ষের লোক হিসেবে দান্তের বিচার শুরু হয়। না, কোন নির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল না। শুধু একটা আঁধারের কালিমা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁর গায়ে। তবুও খাতার পাতায় তোলার মতো একটা অভিযোগ করা হয়েছিল বটে। অভিযোগ করা হল দান্তে এবং তার দলের লোকেরা অসৎ এবং কালো দলের শত্রু। প্রতিবাদ করার কোন জায়গা ছিল না। পোপের নির্দেশে দান্তের শাস্তি হয়। ঘোষণা করা হয় পাঁচ হাজার ইটালিয়ান মুদ্রা জরিমানা। জরিমানা জমা না দিতে পারলে তার সমস্ত সম্পত্তি ধ্বংস করে ফেলা হবে এবং জরিমানা দিলেও দু'বছরের জন্য তাসকিনিতে নির্বাসিত হবেন তিনি। শুধু তাই নয় ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় পদের অনুপযুক্ত ঘোষিত হবেন।

অন্যায় ভাবে তাঁকে শাস্তি দেওয়ার এই প্রচেষ্টায় জেদি হয়ে পড়েছিলেন কবি নিজেও। প্রথমবার ঘোষিত হওয়া এই শাস্তি উপেক্ষা করেছিলেন তিনি। এ দিকে প্রতিপক্ষের ক্রোধ বেড়ে যায়।

১৩০১ সালের ১০ মার্চ ঘোষণা করা হয় যে দান্তেকে কোনভাবে ধরতে পারলেই তাঁকে জীবন্ত অবস্থায় পুড়িয়ে মারা হবে। শুরু হয় এক পন্ডিত মানুষের পলাতক জীবন। তবে শুধু পালিয়ে বেড়াননি তিনি। প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন যুদ্ধের

তাঁর অন্যান্য বিপ্লবী সঙ্গীদের সঙ্গে মিলে তিনি শুরু করেছিলেন পোপের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থান। কয়েক মাসের মধ্যেই তাঁরা আক্রমণ করেন ফ্লরেন্স। নির্বাসিতদের শেষ চেষ্টা। কিন্তু এই আক্রমণ শোচনীয় ভাবে ব্যর্থ হয়। আবার পলাতক জীবন শুরু হয় দান্তের।

কিন্তু ততদিনে অন্তর্দন্দ্ব শুরু হয়ে গেছে এই শ্বেত দলের মধ্যেও। অস্বস্তিতে ভুগতে শুরু করেন কবি। নিজের দলের ভেতরের এই অশান্তি মেনে নিতে পারছিলেন না। দান্তে তখন  নিজের উদ্যোগে আরেকটি দল গড়লেন।

সপ্তম হেনরি যখন জার্মানির সিংহাসনে বসলেন দান্তের মনে নতুন আশা জেগে উঠল। হয়তো সম্রাট সমগ্র দেশকে এক সূত্রে বাঁধার চেষ্টা করবেন। বিশৃঙ্খলা মিটবে ফ্লরেন্সে। তিনি আবার দেখতে পাবেন তাঁর প্রিয় জন্মভূমি। যে জন্মভূমি তাঁকে প্রেয়সীর সঙ্গে দেখা করিয়েছে। প্রবল উৎসাহে দান্তে চিঠি লিখেছিলেন সম্রাটের কাছে। কিন্তু ভাগ্য বিরূপ। ইউরোপে আবার যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন সম্রাট। মৃত্যু হয় তাঁর। দান্তের দেশে ফেরার আশাও মিলিয়ে যায় সেই মৃত্যুর সঙ্গে।

জীবনের শেষ কুড়ি বছর পলাতক জীবন-যাপন করেছিলেন দান্তে। নিজের লেখায় তিনি বলেছেন ''আমি একজন ভবঘুরের মত, ভিখারির মতো ইতালির সর্বত্র আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে নির্যাতনের ক্ষত দেখিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি।"

মৃত্যুর আগেও দান্তের আরও দু’বার বিচার হয়েছিল। কোন ক্ষেত্রেই দান্তে উপস্থিত  ছিলেন না। তার মধ্যে ইউরোপের পরিস্থিতিও অশান্ত ছিল। কিন্তু ১৩১৫ সালে যখন আবহাওয়া কিছুটা শান্ত হল, আবার বিচার হয় দান্তের। খানিকটা করুণা করেন বিচারকরা। ঘোষণা করা হয় তাঁকে জরিমানা দিতেই হবে, নতজানু হয়ে প্রায়শ্চিত্ত অনুষ্ঠান মেনে নিতে হবে। তাহলেই তিনি নিজের জন্মভূমিতে ফিরতে পারবেন। কিন্তু এই করুণার অপমান মেনে নেননি দান্তে। আত্মসম্মানের সঙ্গে আপোষ করেননি কখনো। সসম্মানে নিজের জন্মভূমিতে প্রবেশ করতে চেয়েছিলেন।

শোনা যায় পলাতক জীবনে তিনি ইতালির অনেক অভিজাত পরিবারে আশ্রয় পেয়েছিলেন। ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে নাকি অক্সফোর্ডেও গিয়েছিলেন। তবে এই নির্বাসনকালি দান্তে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থগুলি লিখেছিলেন। ইতালির ভাষাকে সাহিত্য ভাষা হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এই সময় লেখা হয়েছিল সেই আশ্চর্য গ্রন্থ। ‘দা ডিভাইন কমেডি’। জন্ম বিরহী ভাগ্যবিড়ম্বিত এই লেখকের অন্তরের সব কথা ঝরে পড়েছিল ডিভাইন কমেডিতে। বাস্তব জীবনে পরাজিত এই নায়ক নিজের সৃষ্টি করা জগতে স্বর্গ শিখরে আরোহন করেছিলেন।

এই রচনার নাম দান্তে দিয়েছিলেন কমেডি। পরবর্তীকালে দান্তেকে সম্মান জানানোর জন্য ডিভাইন কথাটি যুক্ত করা হয়। আপাত চোখে এই কাব্যকে মনে হয় স্বর্গযাত্রার বর্ণনা। কিন্তু আসলে এটি ছিল দান্তের কল্পলোকের বর্ণনা। রূপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে অনেক কথা।

১৩২৪ সালে এই ভগ্নহৃদয় কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। তবে অনেক ঐতিহাসিক বলেন সাল ১৩২১-এ মারা যান দান্তে। মৃত্যুর বহু বছর পরে ফ্লরেন্স থেকে তাঁকে সম্মান দেওয়া হয়েছিল। তিনি নিজের কনিষ্ঠা কন্যার নাম রেখেছিলেন বিয়াত্রিস। ভালোবাসা, বিচ্ছেদ, যন্ত্রণা দান্তের জীবনকে কুয়াশার মতোই জড়িয়েছিল। তবে এই  কুয়াশার মধ্যে থেকেও সৃষ্টি অবিরাম বৃষ্টির মতই ঝরে পড়েছিল দান্তের জীবনে। তাঁর প্রতি হওয়া অন্যায়, অবিচার তাঁর জীবনকে কন্টকিত করেছিল, দান্তে সেই কাঁটার মধ্যে দিয়ে হেঁটে পৌঁছেছিলেন নিজের অবিস্মরণীয় সৃষ্টির প্রান্তে।

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...