অবন-কন্যা 'উমা'

“আমি তখন খুব ছোট্ট। ভোর হলেই দেখতুম বাবা দোতলায় নেমে আসছেন।….. বাবা মুখ ধুয়ে বাগানে বেড়াতেন।….আমিও খুব ভোরে উঠে গুপিদাসীর সঙ্গে যেতুম বাগানে। শিউলির সময় শিউলি, বকুলের সময় বকুল ফুল কুড়োতুম গাছের তলায়”। আজকের চিৎপুর রোড সংলগ্ন দ্বারকানাথ ঠাকুরের গলিতে যে একদিন এমন অপূর্ব স্বর্গোদ্যান ছিল তা ভাবাই যায় না।

যাঁর স্মৃতিতে এই বাগান, বাড়ি আর তাঁর ‘বাবা’ চির ভাস্বর ছিলেন তিনি উমা দেবী- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠা কন্যা।
১৮৯২ সালে জোড়াসাঁকোর ৫ নম্বর বাড়িতে অবনীন্দ্রনাথ ও সুহাসিনী দেবীর জ্যেষ্ঠা কন্যা উমার জন্ম। শিল্পী বাবা, জ্যাঠামশায়দের সান্নিধ্যে, এক দঙ্গল ভাইবোনদের সাহচর্যে কেটেছে তাঁর শৈশব।

যেখানে ভোরে বাগানে বসে বাবা – অবনীন্দ্রনাথ দেখাতেন আকাশের রং, পরিচয় করাতেন গাছেদের সঙ্গে- কোন গাছের কি নাম, কার কখন ফুল হয়, কোন ফুল কোন রং – এর হয়, কার গন্ধ কেমন-যেমন ছিল, তেমনই ছিল মায়ের পুজোর ঘরে বসে আলতা দিয়ে শরের কলমে দুর্গানাম লেখা। “বাবার মুখে গল্প শোনা”, গরমের চাঁদনি সন্ধ্যায় দিদিমার কাছে ছাতে বসে কত গল্প করা। কোনও কোনও দিন আবার ছ নম্বর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির তেতালার ছাতে বসত আসর – “রবিদাদার গান আর বাবার এসরাজ”। সন্ধ্যেবেলায় আসরে যাবার জন্য দুপুরবেলাতেই পড়াশোনা সেরে নিত ছোটরা। মেয়েদের পড়াতে আসতেন ইন্দুবালা নামে এক মহিলা। পড়ানো ছাড়াও শেখাতেন সেলাই।

উমা ছিলেন বেথুন স্কুলে্র ছাত্রী। খুব বেশিদিন অবশ্য স্কুলে পড়া হয়নি। দশ বছর বয়েসেই বিয়ে হয়ে গেল তাঁর। উমার জ্যাঠতুতো বোন পূর্ণিমা দেবী জানিয়েছেন, ”দিদির বিয়ের বছরই ফাল্গুন মাসে নেলী দিদিরও বিয়ে হয়। দিদির বিয়ের অনুকরণেই সব হয়েছিল”। দ্বারকানাথ ঠাকুরের ভাগ্নে নবীনবাবুর পরিবারে বিয়ে হল উমা দেবীর। পাত্র নির্মলচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বাবা নলিনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ৫ নম্বর বাড়ির কর্তাদের খুব হৃদ্যতা ছিল।

মৃত্যুকালে তিনি ছেলের ভার গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর দিয়ে গিয়েছিলেন। উমা দেবী জানিয়েছেন, ”আমার স্বামী খুব কম বয়সেই পিতৃহীন হন। বাবা ও জ্যাঠামশাইরা তাই তাঁকে নিজেদের কাছে রেখে নানা শিল্প ও ললিতকলার চর্চার মধ্যে ওঁকে বড় করে তুলেছিলেন। সেই জন্যে জোড়াসাঁকোর বাড়ীর সঙ্গে মেশবার এবং ওঁদের কাজের ও ভাবধারার অনুসরণ করবার সুযোগ হয়েছিল আমাদের খুবই”।

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ভাবধারায় সমৃদ্ধ ছিলেন বলেই হয়তো রাখীবন্ধন উৎসবেও জড়িয়েছিলেন নির্মলচন্দ্র। উমার লেখায় আছে ”রাখী পূর্ণিমার আগের দিন রবিদাদা বাড়ীর সকলকে ডেকে বললেন, “কাল আমরা রাখী-বন্ধন উৎসব করব। সকলের হাতে রাখী বাঁধব। দীনু (দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর) আর নির্মল (আমার স্বামী) আমার দুই পাশে গাইবে”। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে হিন্দু মুসলমানকে একসূত্রে বাঁধবার প্রচেষ্টা ছিল সেই রাখী-বন্ধনে।

তার অপূর্ব বর্ণনা আছে অবনীন্দ্রনাথের লেখায়। আছে উমার লেখাতেও। সেলাইয়ে দখল ছিল উমার, অভিনয়ও করতেন চমৎকার। পূর্ণিমা দেবীর স্মৃতিতে ছিল ‘আলিবাবা’ নাটকের কথা - “দাদারা ডাকাত সেজেছিল। নেলীদিদি মর্জিনা আর দাশুদিদি আবদাল্লা সাজে’। নেলী উমারই আর এক নাম। এই অভিনয় উমার স্মৃতিতেও ছিল। তিনি আরও এক গুরুত্বপূর্ণ অভিনয়ের কথা বলেছেন। ‘রত্নাবলী’ নাটক করেছিলেন ৫ নম্বর বাড়ির বউ মেয়েরা।

জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর অনুরোধে হওয়া এই নাটকে অবনীন্দ্রনাথ এঁকেছিলেন দৃশ্যপট, মঞ্চসজ্জার দায়িত্বও ছিল তাঁর। সাজাবার ভার নিয়েছিলেন স্বয়ং জ্ঞানদানন্দিনী এবং অবনীন্দ্রনাথ। বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন স্মারকের ভূমিকায়। মনীষা দেবী বাজিয়েছিলেন হারমোনিয়াম। এইভাবে ৬ নম্বর আর ৫ নম্বর বাড়ির মেয়েরা মিলেমিশে অভিনয় খুব বেশি হয়নি। ‘বিরহ’ নাটকে গোলাপির চরিত্রে উমার অভিনয় মুগ্ধ করেছিল রবীন্দ্রনাথকে।

উমাকে তিনি তাঁর সঙ্গে জাভায় নিয়েও যেতে চেয়েছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ রাজি হননি। তুলি না ধরলেও সূঁচ সুতোর নকশায় তাক লাগাতেন উমা। সেলাইয়ের চেনা ফোঁড় ছাড়াও তৈরি করতেন নানান নতুন ফোঁড়। কাঁথা সেলাই ও করতেন উমা। অবনীন্দ্রনাথ এঁকে দিতেন নানান নতুন নকশা আর উমা সেই নকশায় তুলতেন নানান নতুন ফোঁড়।

তবে উমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান তাঁর স্মৃতিকথা । অস্তাচলের ধারে এসে পূর্বাচলের দিকে তাকিয়ে যেসব ছবি তাঁর স্মৃতিতে ফুটে উঠেছিল তাদের তিনি ধরে রেখেছেন সহজ সরল ভাষায়। সেই স্মৃতিধারার মধ্যমণি অবনীন্দ্রনাথ। কি কোমল, কি নিবিড় সেই সব ফেলে আসা দিন - “ শীতের সময় সন্ধে্বেলা ভাইবোনেরা সবাই মিলে বালাপোশ মুড়ি দিয়ে জমিয়ে বসে গল্প শুনতুম শিমলের দিদির কাছে। বাবাও দিব্যি বালাপোশ মুড়ি দিয়ে বসে যেতেন আমাদের সেই গল্প শোনার আসরে”।

ঘরোয়া অবনীন্দ্রনাথের আরও একটি ছবি পাওয়া যায় উমার লেখায়। শিল্পীগুরুর খাস খানসামা রাদু। তার বউ মারা যাবার কিছুদিন পরে অবনীন্দ্রনাথ রাদুকে আবার বিয়ে করতে বললেন। অবনগৃহিণী সুহাসিনী জানালেন যে রাদুর পক্ষে আর বিয়ে করা সম্ভব নয়, কেন না “বিয়ে করতে গেলে কনের বাপকে ওদের পণ দিতে হয়। কোথায় পাবে ও অত টাকা?” শুনে অবন বললেন, “তাই বলে ওর সংসার হবে না? ও কি সন্ন্যাসী হবে? না না বিয়ে আমি ওর দেবই”। সেদিনই এক চিত্রপ্রদর্শনীতে তাঁর ছবি বিক্রি হল তিনশ টাকায়। বাড়ি ফিরে সে টাকা তুলে দিলেন রাদুর হাতে। তারপর রাদু তো বিয়ে করতে গিয়ে আর আসে না।

অবনীন্দ্রনাথের অসুবিধে দেখে সুহাসিনী দেবী বারবার রাদুকে চিঠি লেখার কথা বলতে লাগলেন। অবন উত্তরে বললেন,” আহা, রোসো। দ্বিতীয় পক্ষের বউ, তাড়াতাড়ি ফেলে আসতে পারে?” শেষে লিখতেই হল এক আশ্চর্য চিঠি। যা শুরু হল 'কল্যাণবরেষু' দিয়ে, শেষ হল ‘তোমার পিতা ঠাকুর অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর' দিয়ে। খানসামাকে চিঠি লিখছেন ঠাকুরবাড়ির কর্তা!এ কি স্নেহ না কি সৌজন্য?

উমার লেখায় আরও কত যে টুকরো স্মৃতিকথা আছে! আছে দিদিমা সৌদামিনীর নাতজামাই -এর সঙ্গে রসিকতার মজার গল্প, আছে স্বদেশী আন্দোলনের সময় গগন- সমর- অবন এবং তাদের রবিকা মিলে খোলা স্বদেশী ভান্ডারের কথা, শিল্পীগুরুরও ছবি আঁকার ক্ষেত্রে যে না-পারার বেদনা ছিল তার কথা , ছোটদের সঙ্গে ছোট হতে পারা অবন ঠাকুরের কত আশ্চর্য কথা।

কি অপরূপ মমতায় আর কি আশ্চর্য দক্ষতায় পুরানো সব দিনকে ধরে রাখলেন এমন একজন যিনি আর কখনও লেখেননি। এই প্রথম, এই শেষ ! ১৯৫১ সালে অবনীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে উমার লেখার সমাপ্তি। দীর্ঘজীবন পেয়েছিলেন উমা। তাই তো গেঁথেছিলেন স্মৃতির মালাখানি। স্বামী নির্মলচন্দ্র মারা গিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ থাকতেই। তার অনেক পরে ১৯৭৮ সালে প্রয়াত হলেন উমা দেবী।।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...