সুধাকন্ঠী সুশীলা দেবী

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে গুণীজনের অভাব ছিল না। এমন অনেক কন্যা ও বধূ ছিলেন, যাঁদের গুণের কথা তেমন ভাবে সর্বজনের কাছে পৌঁছয়নি। তাঁদের অন্যতম সুশীলা দেবীl সেকালের পূর্ব বঙ্গের বরিশাল জেলার লাখুটিয়ার জমিদার রাখাল রায়ের জ্যেষ্ঠা কন্যা সুশীলা দেবীর বিবাহ হয় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পৌত্র দ্বিপেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে।

সুশীলা দেবী ছিলেন সার্থকনামা। মিশুকে, মমতাময়ী এই বধূ ছিলেন সবার প্রিয়। ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী জানিয়েছেন, ‘আমার মা দ্বিপু দাদার প্রথম স্ত্রী সুশীলা বৌঠান কে…. খুব ভালোবাসতেন।’ সুশীলা দেবী ছিলেন সুগায়িকা। তাঁর স্বল্পকালীন জীবনে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির মতো উচ্চমানের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে তাঁর গানের উচ্চকিত প্রশংসা তাঁর গুণের পরিচয় তুলে ধরে।

স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা হিরণ্ময়ী দেবীর বিবাহ উপলক্ষে ‘বিবাহ উৎসব’ নামে একটি গীতিনাটক প্রথম অভিনীত হয়। ফাল্গুন ১২৯০ সালে এই নাট্যাভিনয়ে ‘জ্যাঠামশার পুত্রবধূ (দিনুর মা) সুশীলা দেবী তার নায়ক সেজে বেশ সুন্দর গান ও অভিনয় করতেন’ – জানিয়েছেন ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী। তাঁর গাওয়া ‘ও কেন চুরি করে চায়’ গানটি ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। জোড়াসাঁকো বাড়ীতে নাচ বা রুচিহীন যাত্রা ইত্যাদি হত না।

কিন্তু পারিবারিক ভাবে আনন্দ উৎসবে মহর্ষির আপত্তি ছিল না। একবার এরকম এক অভিনয় দেখে সৌদামিনী দেবী যখন মহর্ষির কাছে গিয়েছিলেন তখন মহর্ষি অভিনয় বিষয়ে জানতে চাইলেন - ‘তাঁহার একটি নাতবৌ পুরুষ সাজিয়া ছিলেন ও সেই সজ্জায় তাঁহাকে সু্ন্দর দেখিতে হইয়াছিল শুনিয়া তিনি হাসিতে লাগিলেন’।

এই নাতবৌটি ছিলেন সুশীলা দেবী। উনিশ শতকের বাংলাদেশে শিক্ষিত সমাজে থিয়সফি বিষয়ে অনেকেই আগ্রহী ছিলেন। জোড়াসাঁকো বাড়িতে মহিলা থিয়সফিক্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন স্বর্ণকুমারী দেবী। সুশীলা দেবী এই সোসাইটির মেম্বার ছিলেন। তিনি হিপনোটাইজ করতেও পারতেন।

১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর সুশীলা দেবীর প্রথম সন্তান দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম হয় মাতার গানের উত্তরাধিকার তিনি সার্থকভাবে বহন করেছিলেন। দ্বিতীয় সন্তান, একমাত্র কন্যা নলিনী দেবীর জন্মের কিছু পর থেকেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত সেই অসুস্থতা ক্ষয় রোগে পরিণত হয়। ‘সেই দুরন্ত রোগের সময় তাঁহার চতুর্থ দেওর ৺সুধীন্দ্রনাথ তাঁহার পার্শ্বে বসিয়া পুত্রের ন্যায় সেবা করিয়াছিলেন।’ যত্ন করেছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী দেবীও।

কিন্তু তাঁকে ধরে রাখা যায়নি। আট বছরের দিনেন্দ্রনাথ ও ছয় বছরের নলিনী দেবীকে রেখে তিনি প্রয়াত হন। থেকে যায় স্মৃতি। তাঁর সুশীল স্বভাবের, সুমধুর আচরণের আর মিষ্টি গলার গানের - ‘যে গানই সে করিত তাহা এতই ভাবের সহিত গাহিতে থাকিত যে তাহাতেই লোকের মনকে মুগ্ধ করিত’ - বলেছেন প্রফুল্লময়ী দেবী।

কোথাও ধরে রাখা হয়নি তাঁর গান। সেকালে সে সুযোগ সহজে মিলত না তাই ঠাকুর বাড়ির অন্দরমহলের আরো অনেক বিস্মৃত সুরের মতই হারিয়ে গেল সেই সুধাকন্ঠ। সুশীলা দেবী তাই আজ এক হারানো সুর।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...