ঠাকুরবাড়ির শিক্ষাবিদ বধু: সুষমা দেবী


মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৃতীয় পুত্র হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ষষ্ঠ কন্যা সুষমাসুন্দরী দেবীর জন্ম জোড়াসাঁকোতে। তাঁর শৈশবেই প্রয়াত হন পিতা হেমেন্দ্রনাথ। তাঁর দিদিরা লরেটোতে পড়লেও সুষমার পড়াশোনা হয়েছিল মূলত বাড়িতে। যদিও তাতে যে শেখায় কোনো ঘাটতি ছিল না তাঁর প্রমাণ সুষমার পরবর্তী জীবন।

১৯০০ সালের মার্চ মাসের ৭ তারিখে সুষমার বিবাহ হয় ব্যারিস্টার যোগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। যোগেন্দ্রনাথ ভালবাসতেন অঙ্ক করতে, লেখালেখি ও করেছেন। স্ত্রীর সব কাজে ছিল তাঁর সমর্থন। দিদিদের মতো সুষমাও ছিলেন গানবাজনায় পারঙ্গমা। ট্রিনিটি কলেজ থেকে পিয়ানোয় ফার্স্ট হয়েছিলেন তিনি। বাজাতে পারতেন এসরাজ এবং বেহালাও। ১৮৯৭ সাল থেকে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে ‘পুণ্য' পত্রিকা প্রকাশিত হতে শুরু করল। লেখা শুরু হল সুষমারও।

তাঁর আগ্রহ ছিল নারীশিক্ষা ও নারী জাগরণে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের কর্মী ও মননশীলা নারীদের জীবনকথা তুলে ধরে তিনি এদেশের অন্তঃপুরচারিণীদের জাগাতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ‘টমকাকার কুটীর' প্রণেত্রী শ্রীমতী হ্যারিয়েট বিচার স্টো, হ্যারিয়েট মার্টিনো, সুইডিশ কিন্নরী বা গায়িকা লিন্ড, রাজনীতি ও রমণীপ্রতিভা ইত্যাদি। এসবের পাশাপাশি সুষমা লিখেছেন গানও। ‘অচল ঘন গহন গুণ গাও তাঁহারি’ ইত্যাদি তাঁর লেখা গান। বেশ কিছু ভ্রমণকাহিনী ও তিনি লিখেছেন। তাঁর মধ্যে ‘শ্রীনগরের পথে’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। Ideals of Hindu Womanhood নামে এক অপ্রকাশিত প্রবন্ধমালায় তিনি সীতা, শৈব্যা, সাবিত্রী, দময়ন্তী ও শকুন্তলাকে ভারতীয় নারীর আদর্শ বলে তুলে ধরেছিলেন।

১৯২২ সালে সুষমা দেবী বালিকা শিক্ষা সংঘ নামে একটি স্কুল খুলে ছিলেন। সেই সময় ঠাকুরবাড়ি সহ বেশ কিছু সম্ভ্রান্ত পরিবারের অন্তঃপুরে শিক্ষার আলো পৌঁছলেও সাধারণ ঘরের মেয়েদের মধ্যে তখনও শিক্ষার বিস্তার তেমনভাবে হয়নি। মেয়েদের জন্যে কিছু করার আগ্রহ থেকেই তিনি যুক্ত হলেন Women Education Society of India’র সঙ্গে।

১৯২৭ সালে তিনি যখন সাতটি সন্তানের জননী তখন তিনি গেলেন আমেরিকায়। ১৯২৭ থেকে ১৯২৯ পর্যন্ত তিনি আমেরিকার নানান অঞ্চলে বক্তৃতা দিয়েছেন। ভারতীয় নারীদের আদর্শ, তাদের বর্তমান পরিস্থিতি, শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে সুষমার বক্তব্যের গভীরতা ও ঔজ্জ্বল্য সে দেশের জনমানসে যথেষ্ট ছাপ ফেলেছিল। ইংরেজি ভাষায় সুষমার দখল, তাঁর পরনের শাড়ি ও দীঘল কালো চোখ সব কিছুই সে দেশবাসীকে মুগ্ধ করেছিল।

ক্যাথারিন মেয়োর ‘মাদার ইন্ডিয়া’-য় ভারতের নারীজাতির যে ছবি তুলে ধরা হয়েছিল, সুষমা তা অগ্রাহ্য করে বলেছিলেন, মাত্র ছ মাস কোন দেশে বাস করে সে দেশ সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, ‘Many of its statements are absolutely falsehoods’ আমেরিকায় থেকে এই বাক্য উচ্চারণ নিতান্ত সহজ ছিল না।

ভারতের জাতিভেদ প্রথা নিয়ে তির্যক প্রশ্নের উত্তরে সুষমার বক্তব্য নির্ভীক ও ঋজু। "I do not think it is as strong in India as it is in your Texas, if my observation enables me to draw the correct conclusion, l noticed it there in the street cars and other places", বলেছিলেন তিনি। আমেরিকায় তিনি এসরাজ বাজিয়ে বেদগান সহ অন্যান্য সঙ্গীত পরিবেশনও করেছিলেন। এই সব অনুষ্ঠানের কথা এদেশে কোথাও প্রকাশিত হয়নি, হয়েছে ওদেশের পত্রিকায়।

১৯২৯ -এর জুলাই মাসে নব অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে সুষমা দেশে ফিরে এলেন। কিন্তু দেশে ফেরার পর আমেরিকার অভিজ্ঞতাকে খুব একটা কাজে লাগাতে পারলেন না তিনি। তাঁর সর্বকাজের সহায় স্বামী ও এক কন্যার মৃত্যু এবং দুই পুত্রের সন্ন্যাস গ্রহণ তাঁর জীবনে এক গভীর সংকটের সৃষ্টি করেছিল।

শিক্ষা বিষয়ে তাঁর ভাবনা ও কাজের গভীরতার কারণেই তিনি World Federation of National Education’র কনফারেন্সে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা তিনি গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন বলেই মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনকেও তিনি সমর্থন করতে পারেননি। পরাধীন দেশে গ্রামীণ শিক্ষাব্যবস্থার প্রসারে তাঁর চিন্তা সত্যিই বিস্ময়কর।

রবীন্দ্রনাথের পল্লী উন্নয়নের ভাবনার উত্তরাধিকার তিনি বহন করেছিলেন। গাছের নীচে খোলা হাওয়ায় হবে ক্লাশ। সেখানে ছাত্র ছাত্রীরা আসছে কিনা সে বিষয়ে নজর রাখবে গ্রাম্য শিক্ষা কমিটি আর প্রত্যেক জমিদারকে এর জন্ম পাঁচ বিঘা জমি দান করতে হবে- এই ধরণের ব্যতিক্রমী চিন্তা সুষমার ব্যক্তিত্বের পরিচয়বাহী।

এহেন মননশীল ধীময়ী নারীর প্রতি ভারত তথা বাংলার গুণীজনদের দৃষ্টি পড়েনি। বিস্মরণের কোন গোধূলিক্ষণের আলোতে তাঁকে কেউ স্মরণ করেনি। এভাবেই বেলা বয়ে গেল। বাজল একদিন শেষ রাগিণীর বীণ। ঝরে পড়ল আরও একটি ফুল, এক বিস্মৃত নক্ষত্র।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...