গুনদাদার শিল্পী কন্যা সুনয়নী দেবী

প্রদীপের নীচে অন্ধকার থাকলেও প্রদীপের পাশটি যে আলোয় ভরা থাকে তার প্রমাণ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির বৈঠকখানা বাড়ির শাখা। যে বাড়ির প্রাণপুরুষ ছিলেন গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর - রবীন্দ্রনাথের ‘গুণদাদা’। শিল্পী পিতা গুণেন্দ্রনাথের শিল্পী কন্যা সুনয়নী দেবীর জন্ম জোড়াসাঁকোতে, ১৮৭৫ সালের জুন মাসের ১৮ তারিখে।

ভারতীয় চিত্রশিল্পের দুই দিকপাল গগনেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভগ্নী সুনয়নী ছোট থেকে শিল্পের আবহে বেড়ে উঠেছিলেন।অবনীন্দ্রনাথের স্মৃতি কথায় আছে, 'ছবি গান ছিল বৈকি বাড়িতে। বাবামশায়ের শখ ছিল ছবি আঁকার। জ্যোতিকাকামশাইও ছবি আঁকতেন।' ছিল আরও কিছু।

শোনা যাক অবনীন্দ্রনাথের বয়ানে - 'ছবি যা দেখেছি তা আমার ছোট পিসিমার ঘরে।…কি সুন্দর ঘরটি তাঁর। কতরকমের ছবি, দেশী ধরণের অয়েল পেন্টিং, শ্রীকৃষ্ণের পায়েস ভক্ষণ…হুবহু কথক ঠাকুরের ছবি।…কেষ্টনগরের পুতুলই বা কতরকমের ছিল সেই ঘরে। ‘অন্তঃপুরের মেয়ে সুনয়নীর মনেও নিশ্চয় এই ছবিগুলো বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল।

Sunayani-Debi1

যদিও নিজের কথা সেভাবে কখনও বলেননি সুনয়নী। আলাদা করে কোথাও শিল্পশিক্ষা হয়নি তাঁর। দুই দাদাকে দক্ষিণের বারান্দায় বসে ছবিতে মগ্ন থাকতে দেখে বড় হওয়া বালিকাটি যে কখন নিজের হাতে তুলি তুলে নিয়েছিলেন তার খবর কেউ রাখেনি। কিন্তু একদিন তাঁর আঁকা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন গগনেন্দ্রনাথ।

অবনীন্দ্রনাথ তখন আর্ট কলেজে। গগনেন্দ্রনাথ তাঁকে বললেন সুনয়নীকে সার্টিফিকেট দিতে। উত্তরে অবনীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সুনয়নীকে তিনি কি সার্টিফিকেট দেবেন, সুনয়নী তাঁর আঁকার মধ্যে দিয়ে সে সার্টিফিকেট নিজেই আদায় করে নেবেন। সেকথা সত্য হয়েছিল।

সুনয়নীর নিয়মিত ছবি আঁকার শুরু তাঁর ত্রিশ বছর বয়সে। সেকালের প্রথা অনুযায়ী বারো বছর বয়সে তাঁর বিবাহ হয় রাজা রামমোহন রায়ের দৌহিত্র রজনীমোহন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ৫ নম্বর বাড়ীতেই থাকতেন রজনীমোহন-সুনয়নী। শুরু দেরিতে হলেও সুনয়নীর একনিষ্ঠতা ছিল আশ্চর্যের।

সকাল আটটা বাজলেই শুরু করতেন ছবি আঁকা। চলত দুপুর পর্যন্ত। সামান্য বিশ্রাম নিয়ে আবার তিনটে থেকে সাড়ে চারটে পর্যন্ত আঁকতেন। এই নিষ্ঠার সঙ্গে ছিল নিজস্ব এক দৃষ্টিভঙ্গি। এই দুয়ের মিলনে সুনয়নীর ছবি স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছে। সেকালের অভিজাত পরিবারের অনেক মেয়েই ছবি এঁকেছেন। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতেও ছবি

আঁকতেন অনেকে। কিন্তু স্বভাবত স্বতন্ত্র ছিলেন সুনয়নী। অবনীন্দ্রনাথ একবার বলেছিলেন, ‘শিল্প হচ্ছে শখ। যার সেই শখ ভিতর থেকে এল সেই পারে শিল্প সৃষ্টি করতে'। সেই অর্থে সুনয়নী ছিলেন যথার্থ শিল্পী। অবনীন্দ্রনাথের মতো জাপানি ওয়াশ পদ্ধতিতে ছবি আঁকতেন সুনয়নী দেবী। স্বতোৎসারিত প্রাকৃতিক অনাবিল আনন্দময় ছিল তাঁর ছবির জগৎ।

Sunayani-Debi2

সুনয়নী দেবীর ছবি নিয়ে প্রথম উল্লেখযোগ্য আলোচনা করেন শিল্প ইতিহাসবিদ স্টেলা ক্র্যামরিশ। তাঁর মতে, সুনয়নী ভারতের প্রথম আধুনিক মহিলা চিত্রশিল্পী। তাঁর আঁকা ছবির বিষয়বস্তু একান্ত দেশজ। যে ‘ভারত শিল্প’-কে খুঁজেছেন অবনীন্দ্রনাথ সেই শিল্পরূপ তার সমস্ত নিজস্বতা নিয়ে সুনয়নীর আঁকায় ফুটে উঠেছে।

তিনি প্রথম যিনি পটচিত্রের আঙ্গিকে ছবি এঁকেছেন। অর্ধনিমীলিত টানা দীঘল চোখ পটের ছবির প্রধান বৈশিষ্ট্য, সুনয়নীর ছবিতেও তা আছে। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, কথকতা, রূপকথার স্বপ্নময় জগত তাঁর ছবিতে ধরা পড়েছে। শিব, কৃষ্ণ, লক্ষ্মী, হরপার্বতী, রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি, অর্ধনারীশ্বর, সতীর দেহত্যাগ ইত্যাদির সঙ্গে আত্মপ্রতিকৃতিও এঁকেছেন সুনয়নী। তাঁর ছবির সারল্য, কোমল পেলবতা, স্নিগ্ধ রঙের খেলা সেকালের অনেক সমালোচকদের মুগ্ধ করেছিল।

১৯০৮ ও ১৯১১ সালে এদেশে তাঁর ছবি প্রদর্শিত হয়। স্টেলা ক্র্যামরিশের উদ্যোগে ১৯২৫ সালে জার্মান আর্ট ম্যাগাজিন Der Cicerone-এ ছাপা হয়েছিল সুনয়নী দেবীর আঁকা ছবি। ১৯২৭ সালে লন্ডনের উইমেন্স ইন্টারন্যাশনাল আর্ট ক্লাব আয়োজিত এক প্রদর্শনীতে তাঁর আঁকা প্রদর্শিত হয়েছিল। তাঁর ছবিতে আধুনিকতা আর চিরকালীন ভারতসত্তা এমনভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে যে তাঁকে এক আধুনিক সমালোচক ‘ন্যাশনালিস্ট আর্টিস্ট’ বলে অভিহিত করেছেন।

সুনয়নী শিল্পচর্চা করেছেন প্রাণের আনন্দে। কোনো নতুন ধারার সৃষ্টিতে তাঁর আগ্রহ ছিল না। ছবি নিয়ে কোনো পরীক্ষা নিরীক্ষাও তিনি করেননি। কিন্তু তাঁর ছবিতেই প্রথম ভারতীয় লোককথা, পুরাণের নিজস্ব ঐতিহ্য এক ভারতীয় নারীর দৃষ্টিতে প্রকাশিত হল। সেখানেই তাঁর অভিনবত্ব। ছবি আঁকার পাশাপাশি কবিতাও লিখতেন সুনয়নী।

এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন যে তাঁর বেশীরভাগ ছবির বিষয়বস্তুই স্বপ্নে পাওয়া। সেই স্বপ্নময় জগত থেকে তিনি সরে গেলেন তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পর। তাঁর প্রথম ছবি থেকে শেষ ছবির মধ্যে কোনও উত্তরণ নেই। তবু অল্পদিনের শিল্পচর্চায় ভারতীয় ছবির ইতিহাসে এক স্বতন্ত্র ধারা তিনি সৃষ্টি করেছিলেন। ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারির ২৩ তারিখে প্রয়াত হন সুনয়নী দেবী।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...