৫ নম্বর জোড়াসাঁকো বাড়ির "সুনন্দিনী"

‘সকাল ন-টা নাগাদ দিদি ও আমাকে নিয়ে বাবা সাহেব পাড়ায় দোকানে যেতেন। সেখানে আমাদের খেলনা কিনে দিতেন…. আবার কখনও কখনও চুল কাটিয়ে আনতেন।' গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বিতীয়া কন্যা পূর্ণিমা ঠাকুরের এই স্মৃতিকথায় ‘দিদি’ বলতে যাঁর কথা বলা হয়েছে, তিনি সুনন্দিনী দেবী - গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও প্রমোদকুমারী দেবীর জ্যেষ্ঠা কন্যা। ১৮৯২ সালে জোড়াসাঁকোর ৫ নম্বর বাড়িতেই তাঁর জন্ম।

সুনন্দিনীর ছোটবেলা কেটেছে জোড়াসাঁকোতেই। পূর্ণিমা দেবী জানিয়েছেন, “দিদির মাথায় চুল কাটা দেখলেই মা ও দিদিমা খুব রাগ করতেন….বাবা বলতেন, 'অত ছোট বয়সে অত চুলের জন্য শরীর খারাপ হয়’।” জোড়াসাঁকোর এই বাড়িতে তখন ও পর্যন্ত মেয়েরা স্কুলে যেত না। লেখাপড়া শিখতে হত বাড়িতেই। বিদেশ থেকে আসা সংবাদপত্র থেকে উল্লেখযোগ্য খবর পড়ে শোনাতেন স্বয়ং গগনেন্দ্রনাথ- “রাজার করোনেশন, জুবিলীর খবর বাবা পড়ে শোনাতেন”।

তারপর পড়তে হত গৃহশিক্ষিকার কাছে-“দিদিরা একজন মহিলার কাছে পড়ত, তাঁর নাম ইন্দুবালা। আমরা তাঁকে ইন্দুমাসী বলতুম। বড়দিদি, নেলীদিদি ও দিদি তাঁর কাছে পড়ত ও সেলাই শিখত”। প্রমোদকুমারী ছিলেন সৌদামিনীর বড় ছেলের বউ। সংসারের সব দায়িত্ব ছিল তাঁর ওপর।

তবু সব কাজ সেরে রাতে সকলের খাওয়া হয়ে গেলে “যখন আলো নিভে যেত, তখন বাতি জ্বেলে মা বঙ্কিমবাবুর বই, আরব্য উপন্যাস ইত্যাদি থেকে গল্প পড়ে আমাদের শোনাতেন। তাঁর চারিদিকে দিদি, নেলীদিদি, করুণাদিদি, আমি সকলে ঘিরে বসে শুনতুম”। এই সঙ্গে ছিল ভোরে উঠে ঠাকুরের জন্য ফুল তোলা, দুর্গানাম লেখা ইত্যাদি।

সুনন্দিনীর বয়স যখন ন-বছর তখন তাঁর বিয়ের কথাবার্তা শুরু হল। দ্বারকানাথ ঠাকুরের ভাগ্নে মদনমোহন চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ির প্রিয়নাথ চট্টোপাধ্যায়ের ছেলে প্রভাতনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করাই ছিল। প্রভাতনাথের ৫ নম্বর বাড়িতে আসাযাওয়া ছিল-“ হঠাৎ শুনলুম বাঁটুলদাদার সঙ্গে বিয়ে হবে। বাঁটুলদাদা আমাদের বাগানে খেলতে আসত”। ১৩০৮ সনের অঘ্রাণ মাসে হল বিয়ে। কি রকম হয়েছিল জাঁকজমক? শোনা যাক,”গায়ে হলুদের আগের দিন সকাল থেকেই বাড়ি সাজান হতে থাকে।

চারিদিকে ঝাড়লন্ঠন লাগান হচ্ছে, ঠুনঠুন আওয়াজ উঠছে আর আমরা ঝাড়ের কলম ভেঙে গেলে কুড়িয়ে নিয়ে চোখে দিয়ে দেখছি কতরকম রং বেরোচ্ছে। তখনও ইলেকট্রিক লাইট হয়নি। ভিতরের বাড়ির বারান্দায়, হলে ঝাড় খাটান হতে লাগল।……বর বসার জন্য মসলন্দ পাতা হল; জরির কাজ করা ভেলভেটের গের্দা পড়ল।….সন্ধের সময় লোকজন জমা হলে দুপাশে তকমা আঁটা উর্দি পরা ছ-জন বেয়ারা হাওয়া করতে শুরু করল।

ফরাসের উপর রূপোর থালায় মিঠে পান সাজানো রয়েছে। চারিদিকে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ঘুরে বেড়াচ্ছে...আতরদান, গোলাপ, ফুলের মালা হাতে নিয়ে খাতির করে সঙ্গে করে নিয়ে যেত আসরে।…..দোতলার হলে পুরুষদের ব্যবস্থা বাবা কাকারা দাঁড়িয়ে থেকে করতেন।….. তিনতলার হলে মেয়েদের বসবার ব্যবস্থা ছিল”। গৌরীদান করেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ।

এই বিয়ের আসরেই সম্প্রদানের সময় এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল ।“বাবা যখন সম্প্রদান করতে যাচ্ছেন, দিদির জ্যাঠাশ্বশুর অমরেন্দ্রবাবু এসে বললেন, 'সেলাই করা কাপড় পরে ত’ মেয়ে সম্প্রদান হয় না’। বাবা বললেন,’দেখুন মেয়ের গায়ে কোন সেলাই করা কাপড় নেই’। “এমনভাবে গগনেন্দ্রনাথ মেয়েকে কাপড় পরিয়ে ছিলেন যে গায়ে যে জামা নেই তা বোঝাই যায়নি। একেই বলে শিল্পীর দৃষ্টি আর শিল্পীর সৃষ্টি।

সুনন্দিনীর প্রথম শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার আগে গগনেন্দ্রনাথ এক আর্টিস্টকে দিয়ে প্রমাণ সাইজের এক ছবি আঁকিয়েছিলেন হাতে কাজললতা, সেই নতুন ধাঁচে কাপড় পরা অপূর্ব কনে বউ। পূর্ণিমা দেবী লিখেছেন, ”দিদি ও নেলীদিদির বিয়ের সময় বাবা দু - একটা অয়েলপেন্টিং করেছিলেন”। সেই অয়েলপেন্টিং -এ কি এই বিয়ের ছবিও ছিল?

সুনন্দিনীর ফুলশয্যার দিন ঘটল আর এক ঘটনা। সুনন্দিনীকে এক সেট হীরের গয়না দেওয়া হয়েছিল। সেই হীরের সেট নিয়ে মেয়েমহলে শুরু হল তর্ক। একদল বলল,' ও হীরে নয়, পোখরাজ'। অন্য দল বলল,'না। ও হীরেই’। জল গড়ালো অনেকদূর। একেবারে গয়নার দোকান কুক্- কেলভির দোকান পর্যন্ত।

যে বাড়ির মেয়েরা বলেছিল পোখরাজ তারা বাড়ির সরকারকে গয়না দিয়ে পাঠাল যাচাই করতে। সরকারের কাছে বাড়ির কর্তার নাম জেনে সাহেব নিজে এলেন তাঁর কাছে। কর্তা খবর নিলেন অন্দরে। শুনলেন ' বাজি ফেলা হয়েছে, যে হারবে একশো টাকা দেবে’। সমস্যার সমাধান করে কর্তা মেয়েদের দিলেন বকুনি। এই ঘটনায় ছ নম্বর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের জড়িত না থাকাই সম্ভব। কেননা, তখনও সামাজিক কাজে পাঁচ নম্বর বাড়িতে তাদের নিমন্ত্রণ হত না।

যাঁর বিয়ে নিয়ে এত শোরগোল সেই ন বছরের মেয়েটি বিয়ে ব্যাপারটা খুব একটা বুঝতেই পারেনি – “দিদি প্রথমটা অত বোঝেনি, ভেবেছিল বিয়েটা ছেলেখেলা হচ্ছে। ওর শ্বশুরবাড়ি আমাদের বাড়ির কাছেই ছিল। যখন দেখল, আমরা বাগানে খেলা করে বেড়াচ্ছি সে আসতে পারছে না। তখন বনের পাখি খাঁচায় বন্ধ করলে যা হয়, ওর অবস্থা তাই হয়েছিল। একবার বাড়িতে এলে আর কিছুতেই শ্বশুরবাড়ি যেতে চাইত না। খুব কাঁদত”।

সুনন্দিনীর শাশুড়ি মোহিত কুমারী দেবী ছিলেন সুলেখিকা ও সাধিকা। নিজের মা-র অন্দরে গৃহবন্দি জীবনযন্ত্রণায় মর্মাহত।অথচ “দিদি না গেলে বা কান্নাকাটি করলে দিদির শাশুড়ী বিরক্ত হতেন,” তাই জোর করে,কখনও কখনও “মা মারধোর করে” পাঠাতেন। বাড়ির কাছে শ্বশুরবাড়ি হওয়ায় দিদিমা সৌদামিনী সুনন্দিনীর পছন্দের তরকারি হলে দাসীদের দিয়ে পাঠিয়েও দিতেন।

প্রাণোচ্ছ্বলা ছিলেন সুনন্দিনী। বিয়ের আগে দাদাদের সঙ্গে পরামর্শ করে ঘুমন্ত পন্ডিতমশাইয়ের টিকি কেটে দিয়েছিলেন। বেশ ভালো গান গাইতে পারতেন তিনি। বিয়ের পরেও ৫ নম্বর বাড়িতে “মৃণালিনী” নাটকে গিরিজায়ার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। পূর্ণিমা দেবীর স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় যে, “বাবা, কাকারাই রিহার্সাল দেওয়াতেন।…ছোটপিসী রবিবারে রবিবারে আসতেন।…. তিনি এসে গান শেখাতেন।…. স্টেজের ভিতর নৌকা দেখানো, কাপড় দিয়ে জলের ঢেউ করা হয়েছিল।

গিরিজায়া গান গাইতে গাইতে নৌকা বেয়ে চলে যায়। নৌকা দোলার সঙ্গে সঙ্গে নিজেও দুলতে থাকে”। অভিনয়ে সব চরিত্রই বাড়ির মেয়েরা করেছিল, ছেলেরা নয়। কেননা, মেয়েদের তখন অনেকেরই বিয়ে হয়ে গিয়েছে “শ্বশুরবাড়ি থেকে আপত্তি করতে পারে” । দর্শকও ছিলেন মূলতঃ মেয়েরাই। সুনন্দিনীর শাশুড়ি অবশ্য এ সব কাজে বাধা দিতেন না। এমনকি গগনেন্দ্রনাথ যখন দার্জিলিং গিয়েছিলেন তখন ছেলেমেয়েদের নিয়ে সুনন্দিনী ও প্রভাতনাথও সঙ্গে গিয়েছিলেন। এর পরে মুসৌরিও গিয়েছিলেন সুনন্দিনী। দুই পরিবারের মধ্যে আন্তরিক সম্পর্ক না থাকলে এসব সম্ভব ছিল না।

লেখালেখি না করলেও হাতের কাজ খুব ভালো ছিল সুনন্দিনীর। পুরোনো কাপড় দিয়ে গুড়িয়া পুতুল বানাতেন তিনি। একবার দানমেলায় রসগোল্লা আর সাপুড়ে গুড়িয়া পুতুল দিয়ে দ্বিতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। তাঁর তৈরি পানওয়ালি পুতুলের কথাও উল্লেখযোগ্য।

দেশীয় শিল্পের প্রচার ও প্রসারে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির অনেক অবদান। দেশীয় পদ্ধতির পুতুল তৈরিতেও এই বাড়ির কন্যার নিজস্বতা অনস্বীকার্য। তখনকার দিনে জামাই ঠকানো খাবার বানানোর বিশেষ কদর ছিল। সুনন্দিনী দেবীর তৈরি ব্লটিং পেপারের রাবড়ি, দুব্বোঘাসের চচ্চড়ি, তুলোর বেগুনি খেয়ে কত জামাই যে ঠকেছিলেন। তবে তাঁর এসব গুণের কথা পারিবারিক বৃত্তের বাইরে প্রকাশিত হয়নি।
‌‌

শেষ জীবনে গগনেন্দ্রনাথ যখন খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তখন তাঁর মেয়েরাই পালা করে রাত জেগেছিলেন।তারপর বাকরুদ্ধ অবস্থায় বছর দশেক কাটাবার পর গগনেন্দ্রনাথ প্রয়াত হন। এর কিছূ পরে বিক্রি হয়ে যায় ৫ নম্বর বাড়িও। প্রমোদকুমারী চলে গেলেন ল্যান্সডাউন প্লেসে। অবনীন্দ্রনাথ বেলঘড়িয়ার গুপ্তনিবাসে। সেখানে একবার অসুস্থ অবনীন্দ্রনাথকে দেখতে গিয়েছিলেন পূর্ণিমা দেবী।

বৈধব্যবেশে পূর্ণিমা দেবীকে অনেক চেষ্টাতেও মনে করতে পারলেন না অবনীন্দ্রনাথ। বলেছিলেন,' কে সুনন্দিনী’? কোথাও কোনো ছাপ রেখে গিয়েছিলেন তবে সুনন্দিনী দেবী। দ্বারকানাথ ঠাকুরের ৫ নম্বর বৈঠকখানা বাড়ি যেদিন বিক্রি হয়ে গেল, তিন ভাই চলে যেতে বাধ্য হলেন তিন জায়গায় সেদিনই ওই বাড়ির শেষ। এরপর ফুল যেমন আপনি ঝরে যায় তেমনই ঝরে গেলেন একদিন সুনন্দিনী দেবীও।।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...